ঈগল সন্ধি ১ম খন্ড - রাজনীতি গল্পের লিংক

মেঘ বিয়োগের মৌসুম (পর্ব ১২-২০) - গ্রামের প্রেম কাহিনী

 'মেয়েমানুষ হলো ভো'গ করার সামগ্রী। এদের জন্ম-ই হয়েছে শরীর দেখিয়ে পুরুষ মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য।'


ঈগল সন্ধি ১ম খন্ড - রাজনীতি গল্পের লিংক
ঈগল সন্ধি ১ম খন্ড - রাজনীতি গল্পের লিংক

{getToc} $title={গল্পের সূচিপত্র দেখুন}

শুরু হচ্ছে একটি বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাস

পর্ব সংখ্যা ০১

গল্পটি লিখেছেনঃ ঝিলিক মল্লিক

-সাহস কত! এই ভার্সিটির মধ্যে মেয়েমানুষকে ইভটিজিং করে বেড়াচ্ছিস! এসব নোং'রা কথা বলেছিস মিরাকে। মানুষ চিনিস? বেয়াদব! মুড়োঝাটার বা'রি দিয়ে বেয়াদবি একদম ছুটিয়ে দেবো। এই ইশা রোকেয়া হলের স্টোররুম থেকে তিন-চারটা মুড়োঝাটা নিয়ে আয় তো। কুইক।


চৈত্রের তেজদীপ্ত চিৎকারে রোকেয়া হলের দিকে ছুটে গেলো দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইশা রহমান। এদিকে আকাশি রংয়ের গেঞ্জি পরিহিত হ্যাংলা গড়নের ব'খাটে হাবভাবপূর্ণ ছেলেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্ছের সামনে অবস্থিত বড় মাঠের মাঝখানে কলার ধরে টেনে নিয়ে ফেললো চৈত্র। আশেপাশে অনেক শিক্ষার্থীরা ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সবার চোখেমুখে কৌতূহল। কী হচ্ছে এখানে অনেকেই বুঝে উঠতে পারছে না৷


-এই সুধা। এদিকে আসো।


পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সবসময় প্রথম হওয়া ছাত্র অভিক বিশ্বাস কিছুটা দূর থেকে চৈত্রের বান্ধবী সুধাকে নিচু স্বরে ডাক দিলো। ওর ডাকে চৈত্রের পাশ থেকে সরে ধীর পায়ে হেঁটে অভিকের সামনে এসে দাঁড়ালো সুধা।

-কী হয়েছে অভিক ভাইয়া। ডাকছেন কেন?

-এখানে কী হচ্ছে? চৈত্র এতো রেগে আছে কেন? মনে হচ্ছে আজকে এই ছেলেটা আর জ্যা'ন্ত থাকবে না!


চন্দ্রাবতী (মিশিতা চৌধুরী)পর্ব-16

-এখন বলার সময় নেই। দাঁড়িয়ে থেকে শুধু দেখুন কী হয়। আমি যাচ্ছি।


রাগের মাত্রা তরতর করে বেড়েই চলেছে চৈত্রের। ওর সামনে পড়ে থাকা ছেলেটার চোখেমুখে ভয়ের কোনো ছাপ নেই৷ বরং দাঁত বের করে কুটিল হাসি দিচ্ছে। ছেলেটার এরূপ হাসি যেন ওর সর্বাঙ্গে আ'গুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কা'টা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো ব্যাপারটা।


-তুই মিরাকে বলেছিস, 'কী হট তুমি। ওড়নাটা খুলে দাও।' ওর ওড়না ধরে টেনেছিস তুই! জানো*য়ার! আজ তোকে আমি এই ভার্সিটির মাঠে ওড়না দিয়ে ক'বর দেবো।


পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মেয়ের হাতে থাকা ওড়না গুলো নিলো চৈত্র। বোঝা-ই যাচ্ছে আগে থেকেই পূর্বপরিকল্পিত ছিলো। এবার বোধহয় বেশ ভয় পেয়ে গেলো ছেলেটা। চোখে ভয়ের আভাস পূর্ণরূপে স্পষ্ট। এরই মধ্যে ইশা চলে এসেছে। ওর হাতে চারটা মুড়োঝাটা। সাথে নিয়ে এসেছে হোস্টেলের আরও কিছু মেয়েকে।


★★ 

ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে বেধড়ক মা'রধর করা হচ্ছে ছেলেটাকে। মুড়োঝাটার শলার আ'ঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ছেলেটার শরীর। ওকে অনবরত মে'রে চলেছে চৈত্র। সাথে রয়েছে কয়েকটা মেয়ে। কেউ ওর বান্ধবী। একই ডিপার্টমেন্টের। আবার কেউ কেউ সিনিয়র ও জুনিয়র। ওদের থেকে কিছুটা দূরে উৎসুক শিক্ষার্থীরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভীড়ের মধ্যে থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে অনেকে। 


★★

-ভাই। ভাই। শিগগিরই চলেন। ওইদিকে ভয়ানক কান্ড ঘটে যাচ্ছে! কয়েকটা মেয়ে মিলে ভার্সিটির  একটা ছেলেরে মা'রতাছে। ছেলেটার অবস্থা..'


বটতলার সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটুকু বলে থামে তুরান। একপাশে কতগুলো বাইক স্ট্যান্ড করে রাখা। এখানে উপস্থিত রয়েছে প্রায় চৌদ্দ-পনেরো জন ছেলে। আজ বহুদিন বাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে ছাত্রলীগের সভাপতি দূর্জয় সেরনিয়াবাত। প্রফেসর সুদীপ্ত কুমারের সাথে একটা বিশেষ দরকারে দেখা করতে। তার সাথে দেখা করে বটতলায় এসে দলের ছেলেদের সাথে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো। হঠাৎ তুরানের মুখে এমন কথা শুনে তড়িঘড়ি করে মুক্তমঞ্ছের সামনের মাঠ প্রান্তের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলো দূর্জয়। ওর পেছন পেছন ছুটলো দলের সাথীরা।


মেঘ বিয়োগের মৌসুম || তানিয়া মাহি (নীরু) - পর্ব-১০+১১

★★

-এখানে কী হচ্ছে এসব?

দূর্জয়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বরে ভীড় সরিয়ে রাস্তা করে দিলো শিক্ষার্থীরা। ওকে দেখেই চিৎকার-চেঁচামেচি বন্ধ হলো। কিছু ছেলেরা মা'রধর দেখে উল্লাস করছিলো, তারা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা ফ্রেম ও সাদা গ্লাসের সমন্বয়ে তৈরী চশমা পরিহিত এই গম্ভীর, তেজী শ্যামপুরুষকে দেখে যেমন পরিস্থিতিই থাকুক না কেন কেউ কোনোরকম আওয়াজ করার সাহস পায় না। 


উপস্থিত সবার ফিসফিসানিতে ছেলেটাকে মার'ধর করার কারণ বুঝতে পারলো ওরা।

দূর্জয়ের পেছনে ওর দলের ছেলেগুলো এগিয়ে গেলো সামনে। মাটিতে পড়ে আছে প্রায় বেহুঁশ একটা ছেলে। 

-আরে এতো কবির! শালা তোর মা'র খাওয়া-ই উচিত ছিলো। 


তুরানের জমজ ভাই নিশান মাঠে পড়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে অবাক ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো। 


চৈত্র দাঁড়িয়ে থেকে কোমরে হাত রেখে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে, ওড়নার কোণ দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে। ওর আশেপাশের মেয়েগুলো ওড়না, মুড়োঝাটা ওঠাতে ব্যস্ত। 

-এই দাঁড়া। মুড়োঝাটা রেখে যা একটা৷ ওকে আরও কয়েক দফা মা'র না দিলে শান্তি হবে না আমার।


কবিরকে আবারও মা'রার উদ্দেশ্যে মুড়োঝাটা উঁচু করে ধরতেই পেছন থেকে কেউ শক্ত করে হাত চেপে ধরলো চৈত্রের।

'যথেষ্ট হয়েছে মেয়ে। এবার থামো।'

দূর্জয়ের চিৎকারে ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকালো চৈত্র। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।

-দেখুন, নেতা সাহেব। আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে আসবেন না একদম। নিজের কাজে মনোযোগ দিন। সভাপতি, সভাপতির মতো থাকবেন। মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলানো আপনাকে শোভা পায় না। এই অ'সভ্য, বে'য়াদব ছেলেটাকে মা'রতে নিষেধ করছেন! অন্যায়কে সমর্থন করছেন?


চৈত্রের কথায় চোয়াল শক্ত হলো দূর্জয়ের। হাত মুঠো করে চড়া গলায় বললো-

'আমি এই ভার্সিটির সাবেক ছাত্র হলেও এখানকার ছাত্রলীগের সভাপতি। তাই ভার্সিটির যেকোনো ভালো-মন্দ ব্যাপার দেখাও আমার কর্তব্য। তোমাকে ঠিক চিনি না মেয়ে। তবুও বলবো, যতটুকু করেছো সেটা যথেষ্ট। এরপর আরো কিছু করলে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছাবে। ওর উচিত ব্যবস্থা করছি। তোমরা এবার যেতে পারো।'


দূর্জয়ের আদেশের সুরে এক ইঞ্চিও সরলো না চৈত্র৷ বরং ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তুরানের চোখের ইশারায় ওকে টেনে মাঠ থেকে নিয়ে গেল ইশা ও সুধা। ধীরে ধীরে মাঠের ভীড় কমে গেল। মাঠে আছে শুধুমাত্র দূর্জয় এবং ওর দলের ছেলেরা। হাঁটু গেড়ে ঘাসের ওপরে উবু হয়ে বসলো সেরনিয়াবাত। কপালে আঙুল ঠেকিয়ে রেখেছে। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে ছেলেরা। 


'নিশান, এটাকে হসপিটালে এডমিট করার ব্যবস্থা কর। আর প্রফেসরকে কল দে। বল, দূর্জয় ভাই বলেছে, দ্রুত ওর বরখাস্ত পত্র তৈরী করতে। এরকম নর্দমার নোং'রা কীট এই ভার্সিটি থেকে সাফাই করা-ই শ্রেয়।'


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর শাবলতলার মাঠ

-ভাই বলছিলাম যে, কবিরকে মা'রছিলো যে মেয়েটা- চৈত্র। পুরো নাম চৈত্র রজনী। ল' ডিপার্টমেন্টের থার্ড সেমিস্টারের ফার্স্ট গাল।

-আমি শুনতে চেয়েছি ঐ মেয়েটার ব্যাপারে?!

-না, মানে ভাই, আমার পুরো কথাটা একটু শোনেন। এর বাপে আলোর শিখা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাস্টার। মেয়েটা চিত্রণ খন্দকারের ছোট বোন। 


রাতুলের শেষ কথাটুকু শুনে চোখ-মুখ শক্ত হলো দূর্জয়ের। কপালের শিরা ফুলে গেছে। হাত মুঠো করলো সেরনিয়াবাত। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,

'শত্রুর বোন! ওকে।'


★★

মেয়েদের হোস্টেলর চতুর্থ ভবনের তেরো নম্বর রুমের বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে চৈত্র। এই রুমটাতে থাকে নিশি, ইশা, তুলি আর রিতু। আপাতত চৈত্রের সাথে রুমে অবস্থান করছে সুধা, তুলি এবং রিতু।


বিছানার এককোণে চুপ মে'রে বসে আছে মিরা। ওর কাঁধে হাত রেখে বসেছে তুলি। রীতিমতো কাঁপছে মিরা। সকালে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে ওর ওপরে। ওর দিকে কিছুক্ষণ নিরবে তাকিয়ে থেকে বিরক্তিতে 'চ' উচ্চারিত হলো চৈত্রের মুখ হতে। মিরার কাছে এগিয়ে গেলো। ওর হাতদুটো মুঠোয় নিলো। 


'দেখ মিরা, এভাবে না এই নিষ্ঠুরতম জগতে বেঁচে থাকা যায় না। ইংরেজি একটা প্রবাদ বাক্য আছে~"ভিক্টরি অর ডেথ।" অর্থাৎ- বিজয় অথবা মৃ'ত্যু। এটি প্রশস্ত অর্থে বোঝানো হয়েছে, হয় স্বাধীনভাবে বাঁচো অথবা মৃ'ত্যুকে আলিঙ্গন করো।'


-তুই কবিরের এসব নোং'রা কথার কোনো প্রতিবাদ করিসনি। এমনকি আমাকে স্বেচ্ছায় জানানোর-ও প্রয়োজন বোধ হয়নি তোর। তুলি আমাকে না বললে তো কবিরের এমন নোং'রামি ধামাচাপা পড়তো। তুইও প্রতিনিয়ত ওর নোং'রামির শি'কার হতি! একসময় তোর ভার্সিটিতে আসা বন্ধ হয়ে যেত। বন্দীদের মতো বসবাস করতে হতো তোকে।'


-এই তুলি, এক গ্লাস পানি দে তো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

মিরাকে কথাগুলো বলে তুলিকে পানি আনতে বলে চৈত্র। ওর কথায় মিরার পাশ থেকে দ্রুত উঠে পানি নিয়ে আসলো তুলি। ঢকঢক করে খেয়ে বোতলের পানি সব শেষ করে ফেললো চৈত্র। সামনে বসে থাকা তার দুই বান্ধবী আর জুনিয়রের তাকানোর চাহনিতে বিরক্ত হলো, ভ্রু কুঁচকালো। ওদের ভাব-গতিকে বেশ বোঝা যাচ্ছে এখনই বকরবকর শুরু হবে।


-চৈত্র, তুই যে আজকে এতো বড় একটা ক্যাচাল করলি। আন্টি যদি জানে তখন কী হবে একবারও ভেবেছিস? তোর বাড়িতে তো তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে রে! 


আশঙ্কিত স্বরে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে সুধা। চোখে অতিসত্ত্বর ভবিষ্যতে সৃষ্ট ঝঞ্ঝা সম্পর্কে ভয়। কথাটা শুনে কিছুক্ষণ কপালে আঙুল স্লাইড  করলো চৈত্র। হঠাৎ ধড়াম করে উঠে বসে ও। মুচকি হেসে বলে, 'তেমন কিছুই হবে না। তুই একটা নেং'টি ইঁদুর। অযথা সবসময় ভয় পাস! আম্মু আমার ওপরে চেঁচালেও, ব্রাদার ঠিক-ই প্রটেক্ট করবে। 


-তুই এখন বাসায় যা চৈত্র। সকাল গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। আন্টি রাগ করবে তোকে।


-আচ্ছা আমি বাসায় যাবো। তার আগে ঐ জানো*য়ারটার খবর নিয়ে যাই। তুলি বাইরে গিয়ে দেখ তো কী অবস্থা। 

চৈত্রের কথায় গলায় ওড়না ঝুলিয়ে হোস্টেল রুম থেকে বের হয় তুলি৷ উদ্দেশ্য কবিরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খবর নেওয়া। 


ভূতুড়ে বাংলো বাড়ি রহস্য (পর্ব-০২) - নাঈম চৌধুরি

★★

-চৈত্র আপা, কবিরকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। 

 

হোস্টেল রুমে প্রবেশ করে বিছানায় বসতে বসতে কথাটা বলে থামে তুলি। ঘেমে-নেয়ে একাকার। বোঝা-ই যাচ্ছে খবর নিতে বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে ওকে। টেবিলে থাকা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে নিলো। গলার ওড়না-টা আলনায় ঝুলিয়ে রাখে। শব্দ করে দরজা আটকে দিলো।


তুলির কথায় সবাই নড়েচড়ে বসে। চৈত্রের মুখের দিকে তাকায় ওর রিয়াকশন বোঝার জন্য। 


'কীহ! ঐ হা'রামিটাকে হসপিটালে এডমিট করলো কে? ওর তো ওখানে পড়ে পড়ে ম'রা উচিত ছিলো।'


ভ্রু কুঁচকে কথাটা বললো চৈত্র। এই খবরটা মোটেও আশা করেনি ও। ভেবেছিলো- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হবে কবিরকে।চোখে-মুখে রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে চৈত্রের।

-শুনলাম ছাত্রলীগের সভাপতি দূর্জয় ভাই ওকে এডমিট করার ব্যবস্থা করেছে চৈত্র আপা।


বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো চৈত্র। বুকে দুই হাত গুঁজে বললো- 'ঐ নেতাকে তো আমি পরে দেখছি। ভাইয়াকে একটা কল দেওয়া দরকার৷ একা বাসায় ফিরবো না। ওর সাথে গেলে জননী একটু কম চিল্লাবে।'


বিছানার এক কার্ণিশ ঘেঁষে বসে চৈত্র। চিত্রণের নাম্বার ডায়াল করে কল দিলো। দু-একবার রিং বেজে কল রিসিভ হলো। 

-হ্যালো রজ্জ। কোথায় তুই?

-আমি ভার্সিটিতে এসেছি ব্রাদার। একটা কাজ কমপ্লিট করে এখন হোস্টেলর রুমে বসে আছি। তুমি জলদি নিতে আসো আমাকে। 


কল কেটে দিলো চৈত্র৷ ও জানে যেখানেই থাকুক কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্যই চলে আসবে চিত্রণ।


★★

ভার্সিটির গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে চৈত্র, সুধা আর তুলি। চিত্রণের আসার অপেক্ষা করছে চৈত্র। এখনো এসে পৌঁছায়নি ও। বিরক্ত হয়ে একটা বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলো ওরা। চারিদিকে একবার চোখ বোলাতেই চৈত্রের নজর গেলো মুক্তমঞ্ছের প্রান্তরে। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয় সেরনিয়াবাত। সবসময়কার মতো দৃঢ় অঙ্গভঙ্গি। কতগুলো ছেলের সাথে কথা বলছে। দূর থেকে অল্প ভেসে আসা শব্দে বোঝা যাচ্ছে রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। কথা বলতে বলতে দু-একবার চোখের সাদা গ্লাসের চশমাটা হাত দিয়ে ঠিক করে নিলো সেরনিয়াবাত। মুখে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব। আবার মাঝে মাঝে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। 

'ছাত্রলীগের সভাপতি দূর্জয় ভাই কী সুন্দর তাইনা! হাসলে অমায়িক লাগে। উনি যদি একবার আমাকে বলতেন, 'তোমাকে আমার চাই।' তাহলে আমি স্বেচ্ছায় তার হয়ে যেতাম। হায়! মা'র ডালা।'


দূর্জয়ের হাস্যরত মুখপানে তাকিয়ে থেকে দাঁত কেলিয়ে একনাগাড়ে কথাগুলো বললো তুলি। ওর কথা শুনে দু'মিনিট ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো চৈত্র। অতঃপর তুলির মাথায় পড়লো গাট্টা।

'এসব কী তুলি! লোকটার বয়স আর তোর বয়সের ডিফারেন্স মিনিমাম দশ বছরের হবে। তোর বাপের বয়সী হয়। আব্বা বল!'


এখন পড়ছেন “সেরা রাজনৈতিক বই”

পর্ব সংখ্যা ২

২.

'এসব কী তুলি! লোকটার বয়স আর তোর বয়সের ডিফারেন্স মিনিমাম দশ বছরের হবে। তোর বাপের বয়সী হয়। আব্বা বল!'

.

চৈত্রের কথায় মুখ বাঁকালো তুলি। ওর এমন প্রতিক্রিয়া দেখে পুনরায় মাথায় টোকা দিলো .  চৈত্র। 

.

কথার মাঝেই চিত্রণ ওদের সামনে এসে বাইক নিয়ে দাঁড়ালো। ওকে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল তিনজন। সুধা আর তুলিকে বিদায় জানিয়ে বাইকে উঠলো চৈত্র।

'এই সুধা তুই বাড়ি ফিরবি না? বাইকে উঠে পড়। ভাইয়া পৌঁছে দিয়ে আসবে তোকে।'


-আমার বাইকে শুধুমাত্র আমার বোন এবং মা ব্যতীত অন্য কারো ওঠার অনুমতি নেই৷  . 

পারলে ঠেকাও ( পর্বঃ ০৪ ) - দিশা মনি

.

চৈত্রের কথায় সুধা কিছু বলার আগেই চিত্রণ গলার স্বরে মারাত্মক গাম্ভীর্যতা মিশিয়ে কথাটা বললো। চৈত্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে প্রস্থান করলো। এদিকে গেইটের সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সুধা। চিত্রণের কথায় ওর খুব খা'রাপ লেগেছে সেটা মুখের প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্ত হচ্ছে। তুলির ধাক্কাধাক্কিতে ধ্যান ভাঙে সুধার। নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় ও। মুখে ফুটিয়ে তোলে জোরপূর্বক হাসির রেখা। নিজ থেকেই তুলির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-

'চিত্রণ ভাইয়ের বোধহয় আজকে মন-মেজাজ ভালো নেই৷ তাই এমন খা'রাপ ব্যবহার করেছে অনিচ্ছায়। নাহলে চিত্রণ ভাই তো এমন লোক নয়। যাইহোক তুই হোস্টেলে চলে যা তুলি৷ আমি একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় রওনা হই।'


★★

বাইকে মুখ ভার করে বসে আছে চৈত্র। রাগের মাত্রা আপাতত চরমে রয়েছে ওর। চিত্রণ যে সুধাকে এভাবে অপমানজনক কথা বলবে এমনটা ঘুনাক্ষরেও আশা করেনি ও। নিজের মতো করে চুপচাপ বাইক চালাচ্ছে চিত্রণ। অন্যদিন, দুইজনে বকবক করতে করতে বাড়িতে পৌঁছায়। তবে আজ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ চিত্রণ।

.

-ভাইয়া তুমি সুধার সাথে এরকম ব্যবহার করলে কেন? আর কী বলছিলে, তোমার বাইকে মা আর বোন ছাড়া অন্য কাউকে ওঠানো যাবে না! তাহলে সেদিন কোন মেয়েকে দেখলাম তোমার বাইকের পেছনে?  . 

.

চৈত্রের কথায় নড়েচড়ে বসে চিত্রণ। মুখের গাম্ভীর্যতা নিমেষেই মিলিয়ে যেয়ে ভয়, আশঙ্কার ছাপ স্পষ্ট হলো। মনে মনে বললো-

'এই রে! ধরেছে, এবার ধরে ফেলেছে। একটু চুপচাপ থাকতে দেবে না। গন্ডগোল বেঁধে যাবে এবার।'  . 


হাইওয়ের একপাশের ধাবার সামনে বাইক থামালো চিত্রণ৷ বাইক থেকে নেমে চৈত্রের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো।

'আজ আমার মেজাজ তুঙ্গে আছে রজ্জ। ভুলভাল কিছু বলিস না, কানের নিচে একটা দিয়ে দেবো।'

.

মেজাজ দেখানোর চেষ্টা করে কথাটা বলে চিত্রণ। তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। বরং ওর কথা শুনে চোখ কুঁচকে, মুখে কঠিন ভাবটা বাড়ালো চৈত্র। বাইক থেকে নেমে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ও।


'আসল কাহিনী কী বলো তো ব্রাদার?'


চিত্রণ বুঝতে পারলো এবার আর নিস্তার নেই। বাঘিনীর কবলে পড়েছে। সত্য কথা বলিয়েই ছাড়বে। 

-আচ্ছা বলবো। আগে দুই কাপ মালাই চা অর্ডার করে আসি।


ধাবার পাশ ঘেঁষা টি-স্টলে গেল চিত্রণ। চা অর্ডার করে ফিরে এলো। চৈত্রের পাশে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলা শুরু করলো-'আজ একটা বিরাট ঝামেলা বাঁধিয়ে এসেছি। কামারপাড়ার গু'ন্ডা মোস্তফা আছে না? ওর সাথে..'

জলফড়িং (পর্ব-০৩) - রিধিমা জান্নাত রূপা

'মা'রামারি করে এসেছো?

.

চিত্রণের কথার মাঝেই ওকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে চৈত্র। চোখের দৃষ্টিতে কৌতূহল। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ মিচকে হাসি। ওর প্রশ্নে মাথা নাড়ালো চিত্রণ। অর্থাৎ, সে সত্যিই মা'রামারি করে এসেছে। এরই মধ্যে টি-স্টলের ছেলেটা এসে চা দিয়ে গেল।   . 

.

'আমিও আজকে মা'রধর করেছি ভাইয়া। ভার্সিটির মাঠে।'

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথাটা বলে চৈত্র। গলার স্বর স্বাভাবিক। তবে ওর কথায় অস্বাভাবিক হলো চিত্রণ। চোখেমুখে আতঙ্ক। ওর এমন প্রতিক্রিয়ায় অবাক হলো চৈত্র। বিরক্তি সহকারে বলে,'তুমি এমন ভয় পাচ্ছো কেন ব্রাদার? জাস্ট মা'রামারিই তো করেছি। ঐ জা'নোয়ারটার পা-দুটো বোধহয় ভেঙেছে শুধু। খু'ন করিনি কাউকে! এভাবে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো মানে নেই।'  . 

.

চায়ের প্লাস্টিকের কাপটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে চিত্রণ। চৈত্রের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ছাড়ে।

'এটা কী আর যে সে আতঙ্ক। এই আতঙ্কের নাম হচ্ছে-"জননী"। আম্মু যদি কোনোমতে জানতে পারে, তার দুই ছেলেমেয়ে আবারও মা'রামারি লাগিয়ে বাড়িতে ফিরেছে! তাহলে কী অঘটন ঘটবে ভাবতে পারছিস রজ্জ? এই ভয়েই আমার মন-মেজাজ খারাপ ছিলো। তাই সুধার সাথে অনিচ্ছায় বাজে ব্যবহার করে ফেলেছি।'  . 

.

চিত্রণের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না চৈত্র। খালি চায়ের কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে বাইকে উঠে বসে ও। ওকে এমন স্বাভাবিক দেখে হতাশ হয় চিত্রণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দেয় ও।    . 


★★

ভেতরবাড়িতে প্রবেশ করে বসার ঘর অবধি পা টিপে টিপে নিঃশব্দে এসেছে চিত্রণ ও চৈত্র। আসরের আযান দিয়েছে মাত্র। ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো চিত্রণ। বিকাল চারটার কাটা ছুঁই ছুঁই! এখন নিশ্চয়ই ওদের মা ভাতঘুম দিচ্ছেন।  একথা ভেবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে দুজনে। 


-----

'দুটোতে কোথায় ছিলি গোটা দিন?'

সিড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই মায়ের ধারালো কন্ঠে থমকে গেল চৈত্র ও চিত্রণের চলন্ত চারখানা পা। তারমানে মা ওদের জন্য অপেক্ষা করে ছিলো। ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরে হাতে হাত বেঁধে দাঁড়ালো ওরা। 'বিড়াল মাছ চু'রি করতে এসে ধরা পড়লে যেমন অবস্থা হয়' আপাতত সেরকম অবস্থা হয়েছে ওদের। 

.

অনিমা বেগমের প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। ওদের দিকে এগিয়ে গেলেন অনিমা বেগম। চোখ বড় করে মুখ খিঁচিয়ে বললেন -'কোনো আক্কেল-জ্ঞান আছে তোদের? এতোবড় ধাড়ি ধাড়ি দুটো ছেলেমেয়ে! সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকা। নাওয়া-খাওয়া নেই।

জ্বীনের খাটিয়া ( পর্ব-০২) - রিয়াজ রাজ
এখানে ওখানে টোটো করে বেড়াও শুধু!'

'তোরা দুটোতে সেই কাঁকডাকা ভোরে বাড়ি থেকে না খেয়ে বের হয়েছিস। একপ্রকার আমাকে ফাঁকি দিয়ে। এখন কয়টা বাজে? সে খেয়াল আছে? নয়-দশ ঘন্টা না খেয়ে কীভাবে থাকে মানুষ। তোদের বাপের তো কোনো চিন্তা নাই৷ স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে সোজা ঘুম। ছেলেমেয়ে কী করছে, না করছে তা তো আর দেখেনা! যত জ্বালা সব হয়েছে আমার।'


দুজনকে ঝেড়ে ক্ষান্ত হলেন অনিমা বেগম। গম্ভীর স্বরে বললেন,'দুজনের খাবার টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখা আছে। নেয়ে, খাবার খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।'

.

অনিমা বেগম সিঁড়ি বেয়ে দোতলার কোণঠাসা ঘরটাতে প্রবেশ করতেই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে দম ফাটানো হাসি দেয় চৈত্র ও চিত্রণ। কিছুক্ষণ হাসির শব্দ তরান্বিত করে যে যার রুমে চলে যায় গোসল সারতে।


★★

বাড়িতে ফেরার পরে ফ্রেশ হয়ে সোজা নিজের দাদীজানের ঘরে এসেছে দূর্জয়। তার মা, বড় ভাবী তোশা ও ভাইজি তুলনার সঙ্গে গল্পে মজেছেন দাদীজান রাণী বেগম। 

.

দরজার নিকটে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দূর্জয়। ভাবলো মহিলা মানুষেরা আলাপ করছে, এখানে তার না আসাই উচিত। তাই দাদীজানের ঘরে না ঢুকেই ফিরে যাচ্ছিলো সে। 

'ও ছোট সেরনিয়াবাত।'

হঠাৎ ঘর থেকে দাদীজানের ডাক শুনে পিছু ফিরে তাকালো দূর্জয়৷ ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো।

'ভেতরে আহো।'

রাণী বেগমের কথায় ঘরে প্রবেশ করলো সেরনিয়াবাত। সোজা দাদীজানের ডানপাশে গিয়ে বসে পড়লো।

.

'খাবার খেয়েছিস আব্বা?'

দূর্জয়কে উদ্দেশ্য করে তার মা রোজানা বেগম কথাটা বলেন।

নিশ্চুপ ভাবে দুপাশে মাথা নাড়ালো দূর্জয়। যার অর্থ-'না।'

.

দূর্জয়ের হাত টেনে নিজের চামড়া কুঁচকানো হাতের মুঠোয় নিলেন রাণী বেগম। সবসময় সোনালী পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত এই বৃদ্ধার চিকন ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে মুচকি হাসি। চোখে ঐশ্বরিক উজ্জ্বলতা। 

'তোমার কাজকর্ম কেমন চলে নাতি?'

'বেশ ভালোই চলছে জান। এবারও নমিনেশন আমি পাবো এবং জিতবোও পরবর্তী সভাপতি পদে।'

.

-এসব রাজনীতি ছেড়ে বাপ-দাদার তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যবসা তো সামলাতে পারিস বাপ! তোর বড় ভাইকে দেখেছিস- কত সুন্দরভাবে বাপের সাথে মিলে ব্যবসা সামলাচ্ছে, সংসার গড়েছে। রাজনীতি করে কী লাভ হবে। এসব ছেড়ে তুইও ব্যবসায় যোগ দে। বিয়ে করে ঘর-সংসার কর। বয়স তো কম হয়নি!'

.

রোজানা বেগমের কথায় ভ্রু কুঁচকে মাথা ঝাকালো দূর্জয়। দাদীজানের হাত মুঠোয় রেখেই মায়ের দিকে মুখ করে বসলো ও৷ একবার বড় ভাবী তোশার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। অন্যদিন তোশা তার হয়ে কথা বলে। অথচ আজ সে নিরব। যার অর্থ, সেও তার শাশুড়ীর দলে ভিড়েছে।

.

'রাজনীতি আমার র'ক্তের শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে মা। দাদাজান হানিফ সেরনিয়াবাত ছিলেন একজন তুখোড় রাজনীতিবিদ, নেতা। বাবা, মাহাতাব সেরনিয়াবাত ছাত্রজীবনে আমার মতোই রাজনীতি করতেন। তিনি তো এমপি পদেও নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। অবশ্যই নির্বাচনে জিতেও যেতেন। শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবেসে, তোমার জন্য রাজনীতি ছেড়েছেন বাবা। আমি এমনটা করবো না। ব্যবসা করা পর্যন্ত মানা যায়। কিন্তু বিয়ে-শাদী করে বউয়ের কথা শুনে রাজনীতি ছাড়বো! অসম্ভব!'   . 

.

দূর্জয়ের এমন নির্লিপ্ত জবাবে রাণী বেগম খুশি হলেও, বিরক্ত হলো রোজানা বেগম ও তোশা। হতাশ সুরে রোজানা বেগম বলে উঠলেন-'তাহলে তো একটা সংসারী জীবন তোর না পাওয়াই থেকে যাবে আব্বা!'

.

'একটা বাংলা গান আছে না মা? কী যেন-

ভূতুড়ে বাংলো বাড়ি রহস্য (পর্ব-০৫) শেষ পর্ব - নাঈম চৌধুরি
'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও,

 আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।

যেটা ছিলোনা, ছিলোনা সেটা না পাওয়াই থাক,

  সব পেলে নষ্ট জীবন।'      


সুর করে গানটুকু গাইলো সেরনিয়াবাত। পুনরায় বলা শুরু করলো। 

'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও মা। আমি নিজেকে ঠিক গুছিয়ে নিতে পারবো। এজন্য বিয়ে করার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছি না আপাতত। সবে আমার ক্যারিয়ারের শুরু। যেটা নেই সেটা নাহয় না পাওয়াই থাকুক। কিছু জিনিস পেয়ে গেলে জীবন নষ্ট হয়।'     . 

কথাটুকু বলে থামে দূর্জয়। ছয় বছর বয়সী তুলনাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে তার মা আর ভাবীর জন্য রেখে যায় একরাশ বিরক্তি।   


★★

সন্ধ্যা হতেই রান্নাঘরের দুয়ারে টুল পেতে বসে আছে চিত্রণ। মাত্রই বাবার সাথে কথা বলে রান্নাঘরে চিত্রণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চৈত্র। ওর বাবা তুহিন খন্দকার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে লাইব্রেরি থেকে আনা 'আঁধার রাতের মুসাফির' বইটি পড়া শুরু করেছেন।         . 

.

চৈত্রের মা অনিমা বেগম ও দিদা বিউটি বেগম পিঠা বানানোর উদযোগ করছেন। বেশ তাড়া নিয়েই কাজ করছেন তারা। কথা রয়েছে-'পিঠা বানানো হলে, চিত্রণ আর চৈত্র গিয়ে ওদের বড় আপা চন্দ্রার শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে আসবে।'        . 

.

কুলোর ওপরে রাখা গরম গরম পিঠা একটা, দু'টো করে প্রায় অর্ধেক উঠিয়ে নিয়েছে চৈত্র আর চিত্রণ। ওদের এহেন কান্ড দেখে তেঁতে উঠলেন অনিমা বেগম। চেঁচিয়ে বললেন-'কী তালবাহানা শুরু করেছিস তোরা। ঘরে যা দু'টোতে। পিঠা বানানো হয়ে গেলে তোদের ডাকবো আমি৷'       . 

.

'কেহ ম'রে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই।' আমি আর তোদের দিদা এখানে খেটে ম'রছি। আর তোরা দুই অকর্মণ্য এখানে কাজ লন্ডভন্ড করছিস। যা, ঘরে যা। এখানে কোনো কাজ নেই তোদের।'            . 

.

'এমনে চেঁচাও ক্যান মাধবী। একটু পিঠা-ই তো খাইছে ওরা!'

.

বিউটি বেগমের কথায় চমকে উঠলো অনিমা আর চিত্রণ। ভ্রু কুঁচকে ফেললো চৈত্র।

'তুমি আম্মুকে কী বললে দিদা? মাধবী! এই মাধবী-টা কে? আম্মুর নাম তো অনিমা। তুমি মাধবী বলে ডাকলে কেন দিদা?'            . 

.

চৈত্রের কথায় থতমত খেয়ে গেলেন বিউটি বেগম। চিত্রণ একবার আতঙ্কিত চোখে তার মায়ের মুখের দিকে তাকালো। পরিস্থিতি বেগতিক পর্যায়ে দেখে উঠে দাঁড়ালো চিত্রণ।      . 

'ঘরে চল রজ্জ। শতরঞ্জি বিছিয়ে লুডু খেলতে বসবো বাবার সাথে।'

.

চৈত্রের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ওকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে গেল চিত্রণ। তবে চোখমুখ থেকে বিস্ময়ের আভা সরলো না চৈত্রের। যেতে যেতে মা আর দিদার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা সামান্য প্রশ্নে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করলো।     .


আপনারা পড়ছেন একটি রাজনীতির গল্প

পর্ব সংখ্যা ০৩


৩.
চৈত্রের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ওকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে গেল চিত্রণ। তবে চোখমুখ থেকে বিস্ময়ের আভা সরলো না চৈত্রের। যেতে যেতে মা আর দিদার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা সামান্য প্রশ্নে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করলো।     .


★★ . 

আজ শতরঞ্জ খেলায় একেবারেই মন বসছে না চৈত্রের। মনের কোণে এখনো 'মাধবী' নামটা-ই বারংবার ঝংকার তুলে চলেছে। অন্যান্য দিনে শতরঞ্জ খেলা জমে উঠতো। 'জমে ক্ষীর হওয়া' যাকে বলে। চৈত্রের আনন্দ-উল্লাসে আসর জমে উঠতো। আসরের মধ্যমণি হতো চৈত্র। তবে আজ সেটা ব্যতিক্রম। সবকিছু কেমন নির্নিমেষ নিস্তব্ধ! দোতলার পুরোনো বড় ঘরের পরিবেশও একইরকম। খেলার ফাঁকে চৈত্রকে বেশ কয়েকবার নীরিখ করেছেন তুহিন খন্দকার।   . 


'মেও!'

আওয়াজ শুনে পেছনে ঘুরে তাকায় চৈত্র। চোখে জাগ্রত হয় পুলক। 

'কী গো মার্জারসুন্দরী? এদিকে এসো। আমার কোলে বসো।'


মার্জারী অভূতপূর্ব সুন্দর ভঙ্গিতে হেলেদুলে হেঁটে এসে চৈত্রের কোলে বসলো আয়েশ করে। তুহিন ও চিত্রণ কিঞ্চিৎ সেদিকে দৃষ্টিপাত করে খেলায় মনোযোগ দিলো। খেলার মাঝেই উপস্থিত হলো-ভাজা চিঁড়ে, মুড়ি ও খই। আসর বোধহয় কিছুটা জমে উঠলো এ কারণে। চৈত্র সহসা 'মাধবী' নামক ব্যাপারখানা মোটামুটি ভুলেই গেল বলা চলে।  . 


রিয়াজ রাজ এর সমালোচারনী - চারনী?

★★

তমিস্রা গ্রাস করে ফেলেছে চারিপাশের পরিবেশকে। সন্ধ্যা নেমেছে। দিনের উজ্জ্বল প্রভার প্রহর কাটিয়ে অন্তরীক্ষে শশধরের আধ ফালা উঁকি দিয়েছে। 

দ্বিতীয়বার খেলা আরম্ভ হওয়ার প্রথম পর্বেই ভঙ্গ হলো। কারণটা হলেন অনিমা। নিচতলা থেকে উচ্চ আওয়াজে চৈত্র ও চিত্রণকে ডেকেছেন তিনি। তড়িঘড়ি করে আসর ছেড়ে উঠলো চিত্রণ। পিছুপিছু চৈত্রও।   . 

'বাবা পরবর্তী আসরে আবারও জিতবো দেখো!'

মেয়ের আলাভোলা কথায় মুচকি হাসলেন তুহিন। বরাবরই শতরঞ্জ খেলায় তিনি এবং চিত্রণ জেতেন। তবে মাঝেমধ্যে মেয়েকেও বিজয়ের সুযোগ করে দেন। 


চিত্রণ তার বাবাকে বলে-'তুমি মাঝেমাঝে যখন রজ্জকে খেলায় জিতিয়ে দাও, তাহলে সবসময় জিতিয়ে দিলেই তো পারো। এতে ও খুব খুশি হবে।'


'মাঝেমধ্যে ওর আনন্দের জন্য জিতিয়ে দিই। তবে সবসময় জিতিয়ে দেওয়া উচিত নয়। একটা মানুষ অলওয়েজ জিততে থাকলে তার অভিধানে 'হার' নামক কোনো শব্দ থাকবে না। ফলশ্রুতিতে এমন হবে, কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত হেরে গেলে সে মেনে নিতে পারবে না। সবসময়ের জিত মানুষকে লোভী ও অহংকারী করে তোলে। চৈত্রকে নিজ গুণে জিততে হবে। নাহলে ওর এই জিত হবে পরনির্ভরশীলতা! যা ওর ব্যক্তিজীবনের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।'


চিত্রণ নিজের বাবার কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। ভাবে কী অদ্ভুত সুন্দর চিন্তাভাবনা এই মানুষটার। বাবার প্রতি পরম শ্রদ্ধান্বিত হয় চিত্রণ।


★★

চৈত্রদের বাড়ির এলাকা শহরাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হলেও মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন, কিছুটা দূরে। অর্থাৎ, এখানে জনবসতি খুবই কম এবং মূল শহরে পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। চন্দ্রার শ্বশুরবাড়ি শহরের জেলা হাইস্কুলের নিকটস্থ। সেখানে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে। তাই অনিমা পিঠাপুলি তৈরিতে বেশ তাড়াহুড়ো করেছেন। 

'শোন এই বক্সে সিদ্ধপুলি আর রসপুলি দিয়েছি। নিচের বক্স গুলোতে তক্তি, পাটিসাপটা, চিতই, আরও অনেক রকম পিঠা আছে। তোরা দুজনে গিয়ে চন্দ্রার শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে আয়।'


চোখেমুখে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে কথাগুলো বললেন অনিমা। বোঝা যাচ্ছে, কোনো কারণে চিন্তিত, বিষন্ন সে। রান্নাঘরের দুয়ারের এককোণে বসে আছেন বিউটি বেগম। বেশ চুপচাপ ভঙ্গিমা। মায়ের মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্টতর লক্ষ্য করে চিত্রণের মন খারাপ হলো। চৈত্রের দিকে নজর দিলো। ও টিফিনবক্স ওলট-পালট করে দেখতে ব্যস্ত। 


'আর শোন, মোটা জ্যাকেট নিয়ে নিস দুজনে। বাইরে অনেক শীত পরেছে। আমি যেন দেখি না শীতের কাপড় ছাড়া বের হয়েছিস!'


শাড়ির আঁচল টেনে মুখের বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা মুছতে মুছতে কথাটুকু বলেন অনিমা। এই ভীষণ শীতেও ঘেমেনেয়ে একাকার সে। মায়ের কথায় মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' সম্মতি জানায় চৈত্র ও চিত্রণ। অনিমা টিফিন ব্যাগে বক্স গুলো পুরে চিত্রণের হাতে তুলে দিলেন। ইতিমধ্যে দুটো শীত পোশাক ও কানটুপি নিয়ে উপস্থিত হলো চৈত্র। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তারা। হাতঘড়িতে চোখ রেখে একবার সময় বুঝে নিল চিত্রণ। সাড়ে সাতটা। এখন চন্দ্রার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলে পৌঁছাবে প্রায় এক ঘন্টায়। আবার সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বেজে যাবে। 


উঠোনে নেমে বাইকে উঠে বসলো চিত্রণ। পেছনে ওর কাঁধে দু'হাত রেখে বসে চৈত্র। কানটুপি, ছাইরঙা লং জ্যাকেটের আবৃতে পশ্চিমা নারীদের ন্যায় অবহিত হচ্ছে ওকে। বাড়ির মূল দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলে-মেয়েকে বিদায় দিলেন অনিমা। মনে আজ ভীষণ উৎকন্ঠা৷ অজান্তেই মনের কোণে দুশ্চিন্তা এসে ভিড়েছে। এতো রাতে ছেলে-মেয়ে দু'টোকে বাইরে পাঠানোর জন্য কিনা কে জানে! এরকম তো পূর্বেও ঘটেছে!


★★

'যদি বারে বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়..'

-তবে সেই প্রেমের কাছে 'ধোঁ'কা' খাইতে কেন যাও?!'


তুরানের বেসুরো গলার গানের মাঝে ওকে থামিয়ে দিয়ে কথাটা বললো নিশান। ওদের সামনের চলন্ত বাইকটা রাইডিং করছে দূর্জয়। ওর সহযাত্রী হিসেবে রয়েছে বন্ধু মুহিত৷ দ্বিতীয় বাইকে রয়েছে তুরান, নিশান ও রাতুল। অনেকদিন বাদে পুনরায় নিজের এতবছরের স্নেহ, ভালোবাসা প্রাপ্ত স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে সেরনিয়াবাত। তার দাদার বন্ধু নাজিমউদ্দীন তালুকদারের নিকটে। যার কাছ থেকে একসময় রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল দূর্জয়ের৷


তুরান আর নিশানের কথাবার্তায় উচ্চস্বরে হাসলো রাতুল। তুরানকে উদ্দেশ্য করে পেছনের সিট থেকে রাতুল বললো-

'ভাই যদি শোনে, তুই এরকম ছ্যাঁ'কাখো'রের মতো গান গাইছিস, তাহলে দল হতে ডিরেক্ট বিতাড়িত করবে। তোর জানা নেই? দলে কোনো দেবদাসকে রাখেন না ভাই! দলে থাকতে হলে, কঠোরতা, ধৈর্য, অনুশীলন এবং অধ্যবসায় নিয়ে থাকতে হবে। ওয়েলিংটনের মতো হতে হবে। শক্ত মনের অধিকারী হওয়া চাই! এরকম ছ্যাঁ'কা হৃদয়ের নয়।'


শেষোক্ত কথাটা যেন তুরানকে উপহাস করেই বললো রাতুল। ওর কন্ঠে ধিক্কার। নিমিষে মনের ওপরে বিরাজতা ফেলে বাইক রাইডিং এ মনোযোগ দেয় তুরান। 


★★

দুপাশের গাছপালাকে দ্রুততার সহিত পেছনে সরিয়ে তমিস্রাকে ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে চিত্রণের নীল বাইক। সবকিছু নিরব, নিস্তব্ধ। প্রভা বলতে শুধুমাত্র চিত্রণের বাইকের হেডলাইটখানা। আর শব্দপ্রকরণ বলতে, ঝিঁঝি পোকাদের আওয়াজ। অনতিদূরে কিছুক্ষণ পরপর দু-একটা ছোটোখাটো দোকান বাঁধছে। মুদি দোকান, আবার চায়ের দোকান। 


মোটা লং জ্যাকেট, টুপির আবরণে সম্পূর্ণ শরীর আবৃত থাকা স্বত্তেও শীতে জুবুথুবু চৈত্র। সামনে বাইক চালানোয় মনোযোগী বছর সাতেকের বড় ভাইকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে সে। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকা দাঁতের পাটি লাগিয়ে নিয়েছে। নির্জন পথ ছেড়ে মূল শহরের বড়ো রাস্তায় উঠেছে তাদের বাইক। যেটাকে বলা হয় 'বিশ্বরোড'। গাড়ি চলছে অজস্র। ভাগ হওয়া রাস্তার ডানপাশে বাইক চালিয়ে নিলো চিত্রণ। এখানে রাস্তা মূলত দুইভাগে ভাগ হওয়া। বামপাশে বড়ো গাড়ি-ট্রাক, প্রাইভেট কার, বাস, এ'ম্বুলেন্স ইত্যাদি চলাচল করে। আর ডানপাশ বাইক, সিএনজির জন্য নির্ধারিত। রাত বাড়ন্ত এবং শীতল রাত্রি হওয়ায় ডানপাশের গাড়ির সংখ্যা খুব কম বললেই চলে। ক্ষণে ক্ষণে দু-একটা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। 


'তোর কী খুব ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে রজ্জ? আমাকে জড়িয়ে ধরে বস্। শীত কম লাগবে।'


ভাব - রিয়াজ রাজ

চিত্রণের কথায় পেছন থেকে চৈত্রের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসলো চৈত্র। ঠান্ডায় সর্দিস্নাত নাকটা চিত্রণের জ্যাকেটে আলগোছে মুছে নিলো। বোনের এহেন কান্ডে মুচকি হাসে চিত্রণ। এখনো আধঘন্টার পথ। 


একবার বামের লুকিং গ্লাসে লক্ষ্য করে সামনে বাইকের আওয়াজ পেয়ে তাকাতেই হঠাৎ! 


হঠাৎই বলা চলে। দু'র্ভাগ্য অথবা আকস্মিক বিপর্যয়! সামনে থেকে আসা একটা বাইকের সাথে মোটামুটি মানের এ'ক্সিডেন্ট হয়েছে চিত্রণদের বাইকের। ফলে রাস্তার পাশের একটা হিজল গাছে ধাক্কা লেগে নীল বাইকটা স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাইক থেকে চিত্রণ আলগোছে পড়ে গেলেও চৈত্রকে শক্ত করে বাইকের সাথে ধরে রাখলো। যাতে ও পড়ে না যায়। ছোটখাটো এ'ক্সিডেন্ট। পরমুহূর্তেই উঠতে গিয়ে ব্যা'থার কারণে হাঁটুতে হাত রেখে পুনরায় রাস্তার পাশে বসে পড়ে চিত্রণ। এমন ঘটনায় মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ ক্ষণিক সময়ের জন্য বোধহয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল চৈত্রের৷ কী হচ্ছে, কী হয়েছে, কিছুই অল্পসময় বোধগম্য হয়নি ওর। যখন হুঁশে আসলো, ব্যাপারটা অনুভব করলো- ধড়াম করে বাইক থেকে নেমে চিত্রণকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ও। রাস্তার পাশ থেকে কয়েকটা গাড়ি চলে গেলেও যেন লক্ষ্য করলো না ওদের। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক! এমন বড়ো রাস্তাগুলো খুব ব্যস্ত থাকে৷ ব্যস্ত থাকে ব্যস্ত শহরের মানুষগুলো, নিজ খেয়ালে। কে কী করলো, কোথায় কী হলো দিনের প্রভাতেও ঘেঁটে দেখে না তারা। সেখানে তো রাত্রিপ্রহর! 


অসহায় চৈত্র রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টর আলোর সহযোগিতায় সামনে তাকায় চিত্রণ। সে হাত উঠিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো, আহামরি কিছু হয়নি। দু'র্ঘটনার প্রায় দু'মিনিট হয়ে গেছে বোধকরে। আবছা আঁধারে দু'টো বাইক সামনের আরেকটা হিজল গাছের নিকটে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে। কতগুলো ছায়া অস্পষ্টতর৷ মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই হাত মুঠো করে, মুখচিত্তে কঠোরতা নিয়ে সামনের অস্পষ্ট ছায়াগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো চৈত্র। যারা এদিকেই আসছিলো।


'দেখে চলতে পারেন না! এতো বড় একটা দু'র্ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন। এখন এর দায় কে নেবে? আমার ভাইয়ের কিছু হলে আপনাদেরকে ছাড়বো না আমি! হা'জতে নিমন্ত্রণে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব বলে দিলাম!'


'ঘটনা-টা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। এখানে কারোই ফল্ট ছিল না। তবুও সরি এবং আমরা তোমার ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো অবশ্যই। যেহেতু আঙুল আমাদের দিকেই তুলছো!'


এক লম্বাকায় শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত পুরুষ আঁধার  ছেদ করে এলো প্রভার সামনে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা হলদে, ঘোলাটে আলোর কিরণ চোখেমুখে ঠিকরে পড়ছে তার। দূর্জয় সেরনিয়াবাতকে দেখে, তার ধারালো কন্ঠস্বরে ঈষৎ চমকালো চৈত্র। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। পেছনে পিচের রাস্তায় বসারত ভাইকে দেখে পুনরায় মাথায় র'ক্ত উঠে গেল ওর।


'ভুল করে আবার দেমাগ দেখাচ্ছেন! যেন সহযোগিতা নয় দয়া দেখাতে চাইছেন আমাদের।'


'ওদের কোনো সহযোগিতার দরকার নেই। আমার তেমন কিছুই হয়নি। এই ফালতু লোকটার সামনে থেকে চলে আয় রজ্জ। গু'ন্ডা কোথাকার একটা!'


পেছন থেকে দূর্জয়কে দেখে বলে ওঠে চিত্রণ। ওর কথা শুনে কিছুটা সামনে এগিয়ে আসে সেরনিয়াবাত। চিত্রণের কাছাকাছি প্রায়। চোখমুখ কঠিনতর করে বলে-'বাহ! সবাই গু'ন্ডা, মা'স্তান আর তুমি একা ভদ্রলোক! 'অতি সাধু বিনাশী'। ভুলটা দুপক্ষেরই ছিলো। নাহলে এ'ক্সিডেন্ট ঘটতো না। এক হাতে তো আর তালি বাজে না। যাইহোক তোকে হসপিটালে এডমিট করা আমার কর্তব্য। উঠে পড়।'


চিত্রণকে ওঠানোর জন্য হাত বাড়ায় সেরনিয়াবাত। তবে ওকে একপ্রকার হিন্য করেই হাত না ধরে নিজে উঠে দাঁড়ালো চিত্রণ। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইকের নিকটে এসে দাঁড়ায়।

'রজ্জ এদিকে চলে আয়। এসব শহুরে গু'ন্ডাদের মাঝে অবস্থান করা ভারী বি'পজ্জনক!'


চিত্রণের কথায় এগিয়ে এসে বাইকে উঠে পড়ে চৈত্র। কী মনে করে যেন আবার পিছিয়ে দূর্জয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় চৈত্র। বুকে হাত গুঁজে বলে-

'নাম আমার চৈত্র রজনী। যদি ভবিষ্যতে পুনরায় কখনো দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেখা হয়ে যায়, তবে বুঝেশুনে কথা বলবেন আশা করি। ত্যাছড়ামো কথা আর কান্ড দেখলে ঠাটিয়ে গালের ওপরে একটা দিতে মন চায়৷ আমার আবার হাত বেশি নিশপিশ করে কিনা! মনে রাখবেন-চৈত্র রজনী!'


'চৈত্র রজনী। এটা কোন ধরনের নাম? নাম রাখবে সহজ-সরল- জরিনা, আকলিমা, প্রিয়া এসব। যাইহোক শ'ত্রুর বোন। তোমাকে তো মনে রাখতেই হবে।'


কথাটুকু বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে সেরনিয়াবাত। ওর এমন অদ্ভুত হাসি এবং নাম নিয়ে কটাক্ষ যেন শরীরে জ্বলন সঞ্চারিত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায় চৈত্রের জন্য৷ বিরক্ত চিত্তে ভ্রু কুঁচকে ও। অপমানিত হওয়ার ব্যাপারটা যেন কোনোমতেই মেনে নিতে পারে না ও। বিরবির করে বলে-'আবারও দেখা হলে দেখে নেব। নেহাৎ আজ সময় কম।'


গটগট পায়ে হেঁটে এসে চিত্রণের বাইকে উঠে বসে চৈত্র৷ চিত্রণ বাইক স্টার্ট করে এস্থান হতে প্রস্থান করলো ওরা। যেতে যেতে চৈত্র উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে বললো-'আসলেই ফালতু। ফালতু নেতা। গু'ন্ডা, মা'স্তান কোথাকার!' 


মেধাবী ছাত্র হবার বৈজ্ঞানিক কৌশল | অধ্যায়-০১ঃ প্রতিভাবানদের ছেলেবেলা

শক্ত ভঙ্গিমায় হিজল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দূর্জয়। ওর পাশে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো বাকিরা। তুরান ফিসফিস করে নিশানের কানের নিকট বললো-

'এ মেয়ে ডে'ঞ্জারাস, ভীষণ ডে'ঞ্জারাস! ভাই হলো এক তারকাঁটা আর বোনটা হচ্ছে মার'কাটা। দুটোরই প্রবলেম আছে বুঝলি।'


শুরু হচ্ছে একটি রাজনৈতিক লেখা

পর্ব সংখ্যা ০৪


'এ মেয়ে ডে'ঞ্জারাস, ভীষণ ডে'ঞ্জারাস! ভাই হলো এক তারকাঁটা আর বোনটা হচ্ছে মার'কাটা। দুটোরই প্রবলেম আছে বুঝলি।'


'দূর্জয়, তুই ঐ মেয়েটাকে কিছু বললি না কেন? তোকে বিনা কারণে এভাবে অপমান করে নির্দ্বিধায় চলে গেল! নিজের ভাইয়ের মতোই বে'য়াদব হয়েছে।'


এখনো অবধি হিজল গাছের সাথে হেলান দিয়ে দন্ডায়মান দূর্জয়ের নিকটে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে মুহিত। চোখে অপারগতা, বি'দ্রোহী ভাব প্রকাশিত। তবে শান্ত, স্বাভাবিক সেরনিয়াবাত। যেন ক্ষণিক পূর্বে কিছুই ঘটেনি এখানে। গাছের সাথে আরো গভীরভাবে শক্ত, পে'টানো পিঠ ঠেকিয়ে নেয় ও। বুকে হাত গুঁজে মুচকি হেসে বলে-'মেয়েটার তখন মাথা ঠিক ছিল না। তাই খা'রাপ বিহেভ করেছে। কাছের মানুষদের কোনো বি'পদ দেখলে যে কারোই মাথা ঠিক থাকে না। ফলে, যা খুশি বলে দেয় যাকে-তাকে! যেমনটা আমার দ্বারাও হয়েছিল বহু আগে।'


'ভাই আপনে না কেমন জানি রহস্য করে কথা বলেন সবসময়!'

দূর্জয়ের পূর্বের কথার সূত্র ধরে বলে তুরান। বরাবরই ওর হেয়ালি কথাগুলো বুঝতে অসুবিধা হয় যে কারো। তুরানের কথায় মাথা নাড়িয়ে পুনরায় মুচকি হাসে সেরনিয়াবাত। যেন বুঝাতে চায়-' হ্যাঁ সত্যিই আমি রহস্যময়! অপার রহস্য বিস্তার করে আমার মাঝে৷ যা ভেদ করা দুঃসাধ্য, দুর্বার। সাধে কী আমার নাম দূর্জয়?! যাকে সহজে জয় করা যায় না সে-ই হলো দূর্জয়!'


সাদা গ্লাসের চশমার বাট দু'আঙুল দ্বারা ঠিক করে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাইকের নিকটে এগিয়ে যায় সেরনিয়াবাত৷ ওর পেছনে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে অত্যন্ত বিস্ময়ে তাকায় তুরান ও নিশান। রাতুল কিছুটা সহজ। নিজেদের নেতাকে ও বহু পূর্ব হতে জানে। কিছুটা হলেও জানে। তাই তার এমন অদ্ভুত আচরণেও মোটামুটি সহজ, স্বাভাবিক সে।


শুধু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মুহিত। মনে মনে কিছু একটা ভাবে সে। বিরবির করে বলে-'তুই আজও চিত্রণের প্রতি অধিক কঠোর হতে পারিসনি দূর্জয়। তবে কী আমি ব্যর্থ?'


★★

চন্দ্রার শ্বশুরবাড়ি হতে চিত্রণের নীল বাইকটার দূরত্ব এখন মাত্র মিনিট দশেক সময়ের ব্যবধানে। এতক্ষণ যাবত চুপচাপ ছিল চৈত্র ও চিত্রণ। হঠাৎ হালকা কন্ঠে চিত্রণ বলে ওঠে-'রজ্জ?'


'হ্যাঁ ভাইয়া বলো।'

'তুই দূর্জয়কে এভাবে ফা'লতু বলে অপমান করলি কেন?'


চিত্রণের কথায় নড়েচড়ে বসে চৈত্র। অবাক হয় ভীষণ। 

'তোমার এরকম একটা এ'ক্সিডেন্ট হলো! সেজন্য তখন আমার মাথা একদমই ঠিক ছিল না ভাইয়া। তাছাড়াও তুমিও তো ঐ নেতাকে ফা'লতু বললে, অপমান করলে। তাহলে আমি বললে দো'ষ কোথায়?'


'আমি বলেছি কারণ ওর সাথে আমার অনেক ঝামেলা আছে আগে থেকেই৷ কিন্তু তোর শুধুশুধু বলা উচিত হয়নি। আর এ'ক্সিডেন্টে বিশেষ  গুরুতর কিছু হয়নি। সামান্য হাঁটুতে ব্যা'থা পেয়েছি। দেখ দিব্যি বাইক চালাতে পারছি।'


চৈত্রকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো চিত্রণ। পুনরায় বলে-'তোর কথাবার্তা শুনে মনে হলো দূর্জয় তোর পূর্ব-পরিচিত। ও তো জেলা শহরের ছাত্রলীগের সভাপতি। তুই চিনিস কীভাবে?'


ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকায় চৈত্র৷ এমনভাবে জেরা করার মতো করে তো কখনো তার সাথে সাথে কথা বলে না ভাই! তাহলে এই লোকটার ব্যাপার নিয়ে এভাবে বলছে কেন! আপাতত মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান সূক্ষ্ম-চিত্র ভাবনাগুলোকে একপাশে জড়ো করে চটপটে ভঙ্গিমায় বলে ওঠে চৈত্র-

'উনি আমাদের ভার্সিটিতে আসেন তো প্রায়সময়। সম্ভবত সাবেক ছাত্র হবেন। আর চিনবো না কোন বলো? ভার্সিটির প্রত্যেকটা মোড়ে মোড়ে, এমনকি নর্দমার সামনের দেয়ালগুলোতেও-'দূর্জয় সেরনিয়াবাত, জেলা শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট   ছাত্রলীগ সভাপতি!' এসব নানান হাবিজাবি লেখা পোস্টার টাঙানো। এমনি বেশ কয়েকবার ভার্সিটিতে দেখেছি ওনাকে৷ আহামরি পরিচিত নয়।'

'কিন্তু তুমি ওই লোকটাকে কীভাবে চেনো ভাইয়া? কীসের ঝামেলা তোমার ওই নেতার সাথে?'

'তোর এতোসব কিছু না জানলেও চলবে রজ্জ। তবে মনে রাখবি- দূর্জয় সেরনিয়াবাত হলো একটা ঈগল, চতুর ঈগল! ওই ঈগল গু'ন্ডার থেকে একশো হাত দূরে থাকবি সবসময়৷ এড়িয়ে চলবি। তবে কখনো ফা'লতু বলবি না দূর্জয়কে। একথা শুধুমাত্র আমি বলি ওকে।'


চৈত্রের মনে খটকা লাগে৷ ভাইয়ের কথাবার্তাও কেমন এলোমেলো, অদ্ভুত, প্যাঁচানো মনে হয় ওর। কিছু একটা বলতে যাবে এর পূর্বেই বাইক থামে চন্দ্রার শ্বশুরবাড়ির- 'মোড়ল বাড়ির' সামনে। স্থানীয় হিসেবে এলাকায় মোড়লরা বেশ প্রভাবশালী। বাইকের আওয়াজ শুনে ইতিমধ্যে অলিন্দে এসে দাঁড়িয়েছে চন্দ্রা ও তার শাশুড়ী মাজেদা বেগম। 

'আরে এরা কারা! পুরনিমার্ চাঁন্দের মতোন ঝলকায়!'


মাজেদা বেগম এগিয়ে গেলেন চিত্রণদের দিকে। পেছনে চন্দ্রাও। 

পারলে ঠেকাও ( পর্বঃ ১০ ) - দিশা মনি

'তোরা এতোরাতে কেন ভাই? ভেতরে চল। এই হিম ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এসেছিস!'


'আম্মু পিঠা বানিয়ে পাঠিয়েছে। এই নাও।'


'আরে আরে কী করো বাজান! ওগুলান আমার হাতে দাও।'


চিত্রণ টিফিনবক্স চন্দ্রার হাতে দিতে উদ্যোত হতেই সেটা একপ্রকার কেড়ে নিলেন মাজেদা বেগম। চন্দ্রাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-'বৌমা, তুমি এগুলান ছুঁইয়ো না এখন। আগে আ'গুনের ছ্যাঁ'ক দিয়া নিই। তারপর ভেতরে নেবো।'


টিফিনবক্স পুনরায় চিত্রণের হাতে রেখে দ্রুততার সহিত অন্দরে প্রবেশ করলেন মাজেদা বেগম। ফিরে এলেন দিয়াশলাই বাক্স নিয়ে। টিফিনবাক্স চিত্রণের হাত থেকে নিলেন। দিয়াশলাই কাঠি জ্বালিয়ে বাক্সে হালকা করে ছুঁইয়ে নিলেন৷ অতঃপর চিত্রণ, চৈত্র ও চন্দ্রাকে নিয়ে মোড়ল বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন।


★★

-ওহে হ্যান্ডসাম! তুমি এসেছো তাহল? এতোদিন বাদে তবে দেখা পাওয়া গেল ঈগলের!'

'কেমন আছেন দাদাজান?'


সিঙ্গেল সোফায় বসতে বসতে নাজিমউদ্দীন তালুকদারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে সেরনিয়াবাত। ওর বন্ধু এবং বাকি সঙ্গী-সাথীরা ডাবল সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। 

'আমি তো বেশ ভালোই আছি। বেশ চলছে দিনকাল। সেই বাইশ বসন্তের মতো।'


নাজিমউদ্দীন তালুকদার সকলের নিকট পরিচিত তালুকদার সাহেব হিসেবে। নিজ বাড়িতে সদস্য বলতে, শুধুমাত্র তিনি এবং কেয়ারটেকার নিয়ামত আলী। স্ত্রী গত হয়েছেন আজ প্রায় আড়াই বছর হতে চললো। দুটো ছেলে-মেয়ে ছিল, তারাও মায়ের মৃ'ত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই কানাডা প্রবাসী হয়েছে। 


'নিয়ামত, ও নিয়ামত।'

রান্নাঘরে কর্মরত নিয়ামতকে ডাকলেন তালুকদার সাহেব। একপ্রকার দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিয়ামত।

'জ্বি হাঁ বাবুসাব। ডাকছিলেন?'

'আমার হ্যান্ডসাম নাতিপুতিদের জন্য চা-কফি লাগাও। তো কী নেবে হ্যান্ডসাম? তোমার জন্য গ্রিন-টি বলি?'


তালুকদার সাহেবের কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় সেরনিয়াবাত।

'আর তোমরা কী নেবে?'

'কফি চলবে দাদু।'

সমস্বরে বললো দূর্জয়ের সঙ্গীরা। 

তালুকদার সাহেবের কথায় হাতে থাকা লম্বা কাগজে কতগুলো ফর্দ টুকে ড্রয়িং রুম থেকে নিমিষে উধাও হলো নিয়ামত। ও চলে যেতে দূর্জয়ের দিকে ঘুরে বসলেন তালুকদার সাহেব। 

'তোমাকে হ্যান্ডসাম বলি কেন জানো? কারণ নিজেই খেয়াল করো। তোমার চুল দু-একটায় সাদা রং ধরেছে। হালকা চাপদাড়িতেও সেটা লক্ষণীয়। তবুও দিন যত যাচ্ছে ততই যেন জোয়ান হচ্ছো তুমি! বয়সের ছাপ চেহারায় নয়, তোমার ব্যক্তিত্বে ফুটে ওঠে৷ একদম হানিফের রুপ পেয়েছো তুমি। হ্যান্ডসাম দাদার হ্যান্ডসাম নাতি সেরনিয়াবাত।'


কথাটুকু বলে হো হো করে হেসে ওঠেন নাজিমউদ্দীন তালুকদার। তার হাসির সারথি হয় মুহিত, রাতুল ও তুরানরা। দূর্জয় শুধু সামনের আরশিতে নিজেকে একবার পর্যবেক্ষণ করে। ভাবে-'দাদাজান যা বললেন আসলেই কী সত্য? তার বয়সের প্রভাব কী তার ব্যক্তিত্বে পড়ে?'


'দাদাজান কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।'

তালুকদার সাহেবকে কথাটা বলে চোখের ইশারায় ড্রয়িংরুমের বাকি সবাইকে বাইরে যেতে বলে সেরনিয়াবাত। সবাই গেলেও মুহিত মূর্তমান বসে থাকে। ভাবে, বন্ধু হিসেবে রাজনৈতিক গোপন আলোচনায় দূর্জয় হয়তো তাকে উপস্থিত রাখবে। তবে মুহিতের ভাবনা ভুল হলো। পুনরায় চোখের ইশারা করলো সেরনিয়াবাত। ফলে একপর্যায়ে ড্রয়িংরুম ছেড়ে বের হয়ে গেল মুহিত। যেতে যেতে একবার পেছনে ঘুরে তাকালো। তালুকদার সাহেব ও সেরনিয়াবাত আলোচনার জন্য প্রস্তুত।


★★

-আরে চিত্রণ ভাইয়া! কেমন আছেন আপনি? কখন আসলেন? আসুন, আসুন। বসুন এখানে। ইশশ ঘেমে-নেয়ে কী অবস্থা!


চিত্রণকে টেনে সোফায় বসায় চন্দ্রার ননদ রিপা। চৈত্রের থেকে বছর তিনেকের ছোট ও। কুড়ির মেয়ে বলা চলে। রিপার এমন টানাহেঁচড়ায় বিরক্ত হয় চিত্রণ। ভ্রু কুঁচকে, জোর গলায় বলে-'তোমাকে না কতবার বলেছি রিপা-'আমাকে ভাইয়া নয় ভাই বলবে। আগে তো চিত্রণ ভাই বলতে!'

জ্বীনের খাটিয়া ( পর্ব-০৫) - রিয়াজ রাজ


'ভাইয়া না বললে তো সাইয়্যা, সাইয়্যা ফিল আসবে না। তাই ভাই বলি কী করে বলুন তো? আপনাকে তো আমার সাইয়্যা মনে হয়!'


রিপার কথায় বিরক্ত হয় চিত্রণ। অস্বস্তিতে এদিক-ওদিক তাকায়। আপাতত তৃতীয় কোনো ব্যক্তি উপস্থিত নেই ড্রয়িংরুমে। থাকলে রিপার এসব কথা শুনে ওকে নির্ঘাত উচ্চমানের 'বেহায়া' উপাধিতে ভূষিত করতো। বিশেষত চৈত্র। 


বর্তমানে চন্দ্রা তার শাশুড়ীর সাথে রান্নাঘরে অবস্থান করছে। হয়তো এতোগুলো দিন বাদে নিজের ভাই-বোনের আগমন উপলক্ষ্যে রান্নার  আয়োজন করছে! চন্দ্রা স্বভবত এমনই। বিয়ের পূর্বেও সর্বক্ষণ ছোট ভাই-বোন দু'টোর খেয়াল রাখতো। বিভিন্ন সময়ে, অবসর সময়ে রান্নাঘরে গিয়ে ভাইবোনদের আবদার পূরণ করতে নানান পদের রান্না করতো। অবশ্য সেসব এখন অবসন্ন অতীত! 


মোড়ল বাড়িতে সদস্য বলতে আপাত দৃষ্টিতে, চন্দ্রা, তার শাশুড়ী মাজেদা বেগম, ননদ রিপা, নয় বছরের ছেলে বিনু এবং অনাগত একজন৷ যার অস্তিত্ব আজ পৃথিবীতে চার মাস তেরো দিন মেয়াদ। জাহিন মোড়ল অর্থাৎ, চন্দ্রার স্বামী দু'মাস হলো দেশের বাইরে আছেন। 


ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে চিত্রণ। এখনো বসার রুম ফাঁকা। সামনে খেয়াল করলো-তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে রিপা। 


'তোমার কথাবার্তায় লাগাম টানা উচিত রিপা। এখন আর বাচ্চা, ল্যাদা নও তুমি। যথেষ্ট বড় হয়েছো। ন্যাকামি ছেড়ে ভদ্রতা শেখো।'


রিপা চিত্রণের কথায় অপমানিত বোধ করে না মোটেও। বরং ফিক করে হেসে ওঠে। চিত্রণের হাত ধরে বলে-'কফি খাবেন চিত্রণ ভাইয়া? তবে আপনার জন্য কফি বানিয়ে আনি?'

-ধ্যাত!

রিপার থেকে নিজের হাত জোরপূর্বক ছাড়িয় নিলো চিত্রণ। ভাবলো-'কফি বানানোর জন্য হলেও এ প্রস্থান হবে। আপদবিপদ সামনে থেকে বিদায় হবে!'

কথাটা ভেবে হ্যাঁসূচক সম্মতি জানায় চিত্রণ। ওর সায় পেয়ে খুশির ঝলক নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় রিপা।


★★

-দূর্জয়ের কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে দাদুর সাথে! যে ও আমাকেও ওখানে থাকার পারমিশন দিলো না!


অলিন্দে পায়চারি করতে করতে জোরে কথাগুলো বললো মুহিত। 

'ভাই তো এমনিতেই দাদুর সাথে রাজনীতি বিষয়ক কোনো আলোচনা করলে আলাদাভাবে কাউকে রাখেন না। সে যে কেউ-ই হোক না কেন!'


রাতুলের শক্তপোক্ত কথায় যে জোর তাতে মুহিতের যেন মনে হলো ওকে অপমান করে বলেছে। এটা অবশ্য সত্য- বরাবরই মুহিতকে অপছন্দ করে রাতুল। এ কারণে বিরক্তির সহিত লম্বা অলিন্দের এস্থান ত্যাগ করে বীপরীত প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো ও। আঁধারে মুহিতের ডানহাতে জ্বলজ্বল করে উঠলো কৃশানুর ফুলকি। পরপরই সেটা মুখের সামনে অস্পষ্ট হলো। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের ধোঁয়ার সাথে এই বি'ষাক্ত ধোঁয়াশার মিশ্রণ ঘটলো।


পড়তে থাকুনঃ রাজনীতিতে একটা কথা আছেে

পর্ব সংখ্যা ০৫


আঁধারে মুহিতের ডানহাতে জ্বলজ্বল করে উঠলো কৃশানুর ফুলকি। পরপরই সেটা মুখের সামনে অস্পষ্ট হলো। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের ধোঁয়ার সাথে এই বি'ষাক্ত ধোঁয়াশার মিশ্রণ ঘটলো।


★★

'ছেলেটার এসব রাজনীতি করা কবে বন্ধ হবে মাসুদের আব্বু? তোমার ছেলের এসব কান্ডকীর্তিতে তো আমি দিনেদিনে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। ম'রে ভূত হবো তবুও ছেলের বউ আর নাতিপুতির মুখ দেখা হবে না বোধহয়। সে কপাল কী আর আমার আছে!'


সিলেটের সপ্তাহখানেকের বিজনেস ট্যুর সমাপ্ত করে সবেমাত্র রাণী মহলে ফিরেছেন দূর্জয়ের বাবা মাহাতাব সেরনিয়াবাত ও বড়ভাই মাসুদ সেরনিয়াবাত। স্ত্রীর কথায় সহসা কোনোরকম তাজ্জব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার অত্যাবশ্যকতা দেখালেন না মাহাতাব। চুপচাপ সোফায় বসে পায়ে পরিহিত সাদা মোজা খুলতে ব্যস্ত হলেন তিনি। তবে মাসুদ হালকা বিদ্রোহ করে উঠলো মায়ের কথায়। 


'আহা মা! কী শুরু করলে তুমি! মাত্র বাসায় ফিরলেন বাবা। এবারের ট্যুরে ধকল সইতে হয়েছে বেশ। তাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। তা নয় তুমি! ভাই যা করছে বা ভবিষ্যতে করবে, সবকিছু ওর নিজের অভিপ্রায়। এখানে তোমার-আমার বা অন্যকারো হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না মা। এমন তো নয় যে ও ডা'কাতি করে বেড়াচ্ছে পুরো শহরে! পলিটিক্স ভালো লাগে, শখ যখন, তাহলে সেদিকেই পূর্ণ মনোনিবেশ করুক ও। দেখবে মা,

অধ্যায়-০২ঃ মেধা : জন্মগত, না অর্জিত?
একদিন তোমার ছোট ছেলেই একজন বড় নেতা হবে। হানিফ সেরনিয়াবাতের নাতি না?!'


বড় ছেলের ছেলের যুক্তিযুক্ত কথার বিপরীতে আর কোনো কথা খুঁজে পেলেন না রোজানা বেগম। সামনের সোফায় বসে থাকা তোশার কোল থেকে ঘুমন্ত তুলনাকে নিয়ে শাশুড়ীর রুমের দিকে পা বাড়ালেন মুখ ফুলিয়ে। তার যাওয়ার পানে একবার নেত্র ঘুরিয়ে দেখে একে-অপরের দিকে তাকালেন মাহাতাব ও মাসুদ। মুখে ফিচেল হাসির রেখা বিদ্যমান।

-বুঝলে বাবা, এখন দাদীর ঘরে যাবে মা। সেখানে একরাশ অভিমান, অভিযোগ আর নালিশ ব্যক্ত করবে। দো'ষীদের তালিকায় কিন্তু তুমি আর আমিও আছি!


বড়ছেলের কথায় জোরে হেসে মাথা নাড়ালেন মাহাতাব সেরনিয়াবাত। তোশার দিকে ফিরে বললেন-'তালিকায় তুমিও আছো নাকি বৌমা?'


বরাবর নিশ্চুপ তোশা নিরবে মাথা নাড়িয়ে 'না' সম্মতি জানায়। সিড়ির নিকটে দন্ডায়মান মাসুদের সহিত চোখাচোখি হয় ওর। পরমুহূর্তেই চার বিশাল কৌণিক ড্রয়িংরুম পেরিয়ে মাসুদের পিছুপিছু দোতলায় উঠে যায় ও।


★★

তালুকদার ভবনের পেছনের কান্তারের সমগ্রভাগে এসে দাঁড়িয়েছে মুহিত। একজনের সাথে কথা বলার জন্য। মিনিট কিছুক্ষণ পূর্বে সি'গারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে সিক্ত করার ক্ষণে মুঠোফোনে একটা এসএমএস আসে ওর। 'স্যার' উল্লেখে নাম্বার সংরক্ষিত করা ব্যক্তির এসএমএসটা এমন-"পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে কল করো৷ ওর সব আপডেট চাই আমার।"


রাতুলরা অলিন্দের মধ্যভাগে উপস্থাপিত বেতের সমাহারে বসে চা-আড্ডায় মগ্ন৷ তালুকদার ভবনের অন্দরমহলে দূর্জয় আলোচনায় ব্যস্ত তালুকদার সাহেবের সাথে। এই মুহূর্তকে সুঃক্ষণ ধারণা হলো মুহিতের নিকট৷ আজ সারাদিনেও 'স্যার'-কে ফোন দেওয়ার সুযোগ হয়নি ওর। তাই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দ্রুততার সহিত কল লাগায় ও। দুবার রিং বাজতেই কল রিসিভ হয় ফোনের ওপাশ হতে। 

-হ্যালো স্যার।

....

'হ্যাঁ দূর্জয় এখন তালুকদারের সাথে কীসব আলোচনায় ব্যস্ত। পথে একটা ঘটনা হয়েছিল। একটা দূ'র্ঘটনা বলা চলে। ওই চিত্রণের সাথে আবারও দেখা হয়েছিল ওর। স্যার, আমার মনে হয় দূর্জয় আজও চিত্রণের প্রতি অধিক কঠোর হতে পারেনি। নি'র্দয় হয়নি। যদি তাই হতো তবে আপনি যা চান সেসব খুব জলদিই ঘটতে পারতো। কারণ দূর্জয়ের একমাত্র কঠিন শ'ত্রুতা তো চিত্রণ খন্দকারের সাথে।'


ফোনের ওপাশ হতে 'স্যার' সম্বোধিত ব্যক্তিটা কিছু বলতেই কিঞ্চিৎ বিচলিত হয় মুহিত। 

'জ্বী স্যার। কান পড়িয়ে হোক অথবা মস্তিষ্কের মাধ্যমে, আমি আমার সর্বোচ্চ দ্বারা সবসময় চেষ্টা করছি, দূর্জয় আর চিত্রণের ঝামেলা বাঁধিয়ে রাখতে। তবে দূর্জয় যেমন মানুষ! ওকে টলানো ভীষণ কষ্টসাধ্য। আমার তো ভয় হয়, ও হয়তো সামনের এমপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ভেবে না বসে! এমনটা হলে আপনার এতো বছরের সব পরিকল্পনার গোড়ায় জল! আপনি না-হয় নতুন পরিকল্পনা ভাবুন। যাতে দূর্জয়কে ওর অবস্থান থেকে সরানো যায়। 

.........

-অবশ্যই স্যার। আমি একেবারে চিনে জোঁকের মতো ওর সঙ্গে লেগে থাকবো। যতক্ষণ না আপনার কার্যসিদ্ধি হয়। আর স্যার আমার পেমে..'


মুহিত আরো কিছু বলার পূর্বে ওপর পাশের স্যার নামক ব্যক্তি ফোন কে'টে দিলো। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে পুনরায় ধূ'মপানের প্রস্তুতি নিলো মুহিত।


★★

-ও চৈত্রমা, তোরা বরং আজকে থেকে যা আমাদের কাছে। চিত্রণ বাজান, তোর মা-রে ফোন কইরে বল, আজকা আমাদের বাড়িতে থাকবি তোরা। এতো রাইতে আর ঐ বড় রাস্তা দিয়া যাওনের দরকার নাই। ঐ রাস্তায় এমনিও ছুঁৎ আছে। না জানি রাত-বিরেতে কী হয়!

-মা ঠিকই বলেছেন। তোরা আজকে থেকে যা। ভাই তুই আম্মাকে ফোন করে জানিয়ে দে।


শাশুড়ীর কথায় সায় জানিয়ে চন্দ্রা বললো চিত্রণ আর চৈত্রের উদ্দেশ্যে। চৈত্র মৌন-সম্মতি জানালেও চিত্রণ বেঁকে বসে। তাদের থাকার কথা বলতেই রিপার চোখেমুখে যে ঝলকময় মানচিত্র  দেখা দিয়েছে সেটাই মূলত চিত্রণের বেঁকে বসার কারণ।


বসার ঘরে অবস্থান করছে চন্দ্রা, মাজেদা বেগম, রিপা ও তারা দুই ভাই-বোন। বিনু মাজেদা বেগমের ঘরে ঘুমোচ্ছে। চায়ের কাপ সামনের টি-টেবিলে রাখলো চিত্রণ। সকলের অলক্ষ্যে ফিসফিস করে চৈত্রের কানের নিকটে মুখ এগিয়ে বললো-'রজ্জ। এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। ঐ বে'হায়া রিপার হাবভাব দেখেছিস? আমার তো ভয় হয়, মাঝরাতে আমার শ্লী'লতাহানি করতে চলে না আসে! না, না! এই মেয়ে অ'পবাদ দিয়ে আমার গলায় ঝুলে পড়তে চাইলে আমি মোটেও মেনে নেবো না। বাড়ি ফিরে যাই রজ্জ। তুই আপাকে বল।'


চিত্রণের কথায় লোকজন কালেভদ্রে ভুলে বসার ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে চৈত্র। যেন মিস্টার বিন তার পাশে বসে আছে এবং সে দর্শক। এমন হাসিতে ওদের থাকার ঘর নিয়ে আলোচনায় মগ্ন চন্দ্রা আর তার শাশুড়ী মাজেদা বেগম চমকে উঠলেন৷ চন্দ্রা ভ্রু কুঁচকে একবার চৈত্র আর চিত্রণকে পরখ করে নিলো। একটা হতাশামূলক দীর্ঘশ্বাস ফেললো এই ভেবে যে-'আজও তার ভাই-বোনগুলো মানুষ, জন দেখে আচরণ শেখেনি।' নিজেকে অসফল দায়ী করলো। মায়ের কথা অনুযায়ী সবসময় মানুষ, স্থান দেখে সঠিক আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছে সে তার ভাই-বোনকে। 

'আরে মাইয়া! করো কী? এতো জোরে হাসলে পেত্নীতে ধরবে! ভূত-প্রেত্নীর ছুঁৎ লাগলে পরে বিয়া-শাদী হবে না।'


চন্দ্রা কিছু বলার পূর্বেই চৈত্রকে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন মাজেদা বেগম।

'মা আপনি এসব ছুঁৎ এর কথা ছাড়েন তো। আমি শুধু ভাবছি আর অবাক হচ্ছি-'এই দুই গর্দভকে আমি এতোবছরে কী শেখালাম। এখনো হাসলে মনে হয় পা'বনা থেকে পালিয়ে এসেছে৷ পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে তো ওর হাসির ধরণ দেখেই পালাবে!'

-ঠিক কইছো বৌমা। তোমরা কিন্তু যাইতাছো না। তোমার মা-রে ফোন দিয়া আমি কইয়া নেবো। তোমরা জ্যাকেট, সুয়েটার খোলো। রাইতের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি, টেবিলে আসো। ও বৌমা, তুমি আমার সাথে আসো তো।

মাজেদা বেগম ট্রে নিয়ে ডাইনিং এর দিকে এগোলেন৷ সঙ্গে চন্দ্রাও। যাওয়ার সময় ইশারায় একবার চিত্রণ ও চৈত্রকে শাসিয়ে গেলো।


★★

মাসুদের কথা অনুযায়ী রান্নাঘরে কফি বানানোর উদ্দেশ্যে গিয়েছিল তোশা। কফির কাপ নিয়ে রুমে ফিরে এসে দেখলো মাসুদ নেই রুমে। ভাবলো ব্যালকনিতে আছে৷ কফির কাপ টেবিলে রেখে ব্যালকনির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ও।

'আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন?!'

হঠাৎ তোশার আগমনে চমকে পেছনে ফিরে তাকালো মাসুদ। তোশার আতঙ্কিত চোখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দৃষ্টি ফেললো। দু'মিনিট এভাবেই স্থিরতাময় সময় কাটলো। 

'জ'ল্লাদের সাথে।'

তোশার প্রশ্নের বিপরীতে মোটা স্বরে কথাটা বলে মাসুদ। ওর আতঙ্কিত চেহারা দেখে পরমুহূর্তেই হো হো করে হেসে ওঠে। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলে-'কাকিমণির সঙ্গে কথা বলছিলাম। আগামীকাল তিনি এবং মৌরি আমাদের বাড়িতে আসছেন৷ হয়তো এবারের অবস্থান হবে মাসখানেক। তুমি মা, দাদীকে জানিয়ে দিও একথা।'

'আচ্ছা। আপনার কফি রেখে এসেছি রুমে। ঠান্ডা হওয়ার আগে খেয়ে নিন।'

মাসুদের কথায় নিরবে সায় দিয়ে ব্যালকনি পার হতে যাবে তৎক্ষনাৎ শীতল স্পর্শ অনুভূত হলো তোশার হাতে। পরিস্থিতি বুঝে চমকে উঠলো ও। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা চালালো। তবে সহজে কাজ হলো না। পেছন থেকে ইতিমধ্যে ওকে আড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে মাসুদ। কাঁধে গরম নিশ্বাস পড়তেই কেঁপে ওঠে তোশা। ভয়ার্ত চোখে পালানোর পথ খোঁজে ও। মাসুদ আরও কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয় তোশার। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে-

'তুমি আমার থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াও কেন বউজান? এমন ব্যবহার করো আমার সাথে যেন কত জ'ঘন্য পা'প করেছি আমি!'

'আমি পা'পী, তুমি পবিত্রা,

আমি তমিস্রা, তুমি প্রভা,

আমি অমাবস্যা, তুমি পূর্ণিমা।

এরকম হলেও হতে পারতো। কিন্তু ব্যাপারটা তো এমন নয়। তবে তুমি প্রতিনিয়ত চাতক পাখির ন্যায় পালিয়ে বেড়াও কেন বউজান? আমাকে সর্বদা হৃদয়ের দংশনে দংশিত করো! কেন?'


মাসুদের প্রশ্নের কোনো জবাব আপাতত মস্তিষ্ক উল্লেখ করতে চাইছে না তোশার মনে। বরং সে চাইছে না মাসুদের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে। দেবে কী করে! যে প্রশ্ন, যে প্রশ্নোত্তর বোধগম্য স্বত্ত্বেও বারংবার জিজ্ঞাসা করা হয় তার জবাব তৎক্ষনাৎ কী হতে পারে! 


নিজেকে পুনরায় ছাড়ানোর চেষ্টা চালায় তোশা। তবে সেটা সম্ভব হয় না। ধরাশায়ী বুঝে চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট চেপে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে তোশা৷ বোঝে এই মূহুর্তে মাসুদের নিকটে সে ধরাশায়ী। পাখি যেমন শিকারীর কাছে ধরা পড়ার সূচনায় ছটফট করে, পরবর্তীতে বিপদ বশীর ধার্য বুঝে ছটফটানি থামিয়ে দেয়, তেমনই নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা দুঃচেষ্টা বুঝতে পেরে তোশাও সেই চেষ্টা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে নিরবে।


★★

তালুকদার ভবনের বসার ঘরের বড় দেয়ালঘড়িতে চোখ পড়লো দূর্জয়ের। সময় সাড়ে দশটার কাছাকাছি। তবুও আলোচনা যেন আজ থামতেই চাইছে না।

অবুঝ দিনের ভালোবাসা (প্রথম খন্ড) - গল্পকন্যা
তালুকদার সাহেব এমন ব্যক্তি- যার সান্নিধ্যে একবার আসলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তার কথাগুলো শুনতে ইচ্ছা করে এবং প্রতিনিয়ত সে আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়৷ 


________


'ভাই এতো কী আলোচনা করে দাদুর সাথে! দেড় ঘন্টা যাবত বসে থেকে ঘুম পাচ্ছে এখন।'


নিশানের কথায় হালকা ঝিমতে ব্যস্ত রাতুল সজাগ হয়। লাফিয়ে সোজা হয়ে বসে। 

'কয়টা বাজে নিশান?'

'সাড়ে দশটা।'

'আজকে এতো কীসের আলোচনা চলে? ভাই কী এমপি নির্বাচনে অংশ নেবে নাকি! যে এমন দীর্ঘ আলোচনা হচ্ছে।'

তুরানের কথায় নড়েচড়ে বসে রাতুল। পেছনের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে মুহিত৷ নিজের খেয়ালে। সেদিকে একবার পরখ করে নেয় ও।

'হতেও পারো। ভাইকে তোরা চার বছর যাবত চিনিস। আর আমি চিনি আট বছর ধরে। এতোদিন ভাইয়ের সাথে থেকে এতোটুকু তো তাকে চিনেছি যে সে কখন কী করতে পারে।'

'আচ্ছা ভাই কী বিয়েশাদি করবো না?'

'হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন তুরান?'

'না মানে, ভাইয়ের বয়স তো কম হয় নাই। ত্রিশ-বত্রিশ হবে না? চুলেও দু-একটা পাক ধরছে। অবশ্য ভাইরে দেখলে সঠিক আন্দাজ করা যায় না। কিন্তু ভাইয়ের মা তো তার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগছে। এই বছরে মনে হয় বিয়ে দিয়েই ছাড়বো।'

তুরানের কথা শুনে হু,হা বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় রাতুল। তবে নিশান চুপ থাকে না। মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড়ে তার মাঝেমধ্যে। আজ দারুণ সুযোগ মনে হলো ওর। তাই রাতুলকে  জিজ্ঞাসা করলো-'দূর্জয় ভাই প্রেম করা পছন্দ করে না কেন রাতুল ভাইয়া?'


'আমি কী করে জানবো! তবে এটা বিশেষ কিছু নয়। সম্ভবত ভাইয়ের ধারণা রাজনীতি করতে হলে শুধুমাত্র সেদিকেই ফুল ফোকাস করতে হবে। শুনিসনি, ভাইয়ের সাবজেক্টও ছিল রাজনীতি বিষয়ক? মূলত রাজনীতি নিয়েই পড়াশোনা করেছেন তিনি।'


রাতুলের কথায় অবাক হয় তুরান ও নিশান। এই ব্যাপারটা তারা বিশেষভাবে জানতো না। সহসা তুরান বলে ওঠে-'আসলে নেতারা প্রেম করলে হয় সিলেকশন নীতি, প্রেমে ছ্যাঁ'কা খাইলেই সেটা হয়ে যায় দুর্নীতি। তখন প্রেমকে মনে হয় স্বৈরতন্ত্র নীতি। মূলকথা সবই হলো রাজনীতি।'


পড়ুন একজন ত্যাগী নেতার গল্প

পর্ব সংখ্যা ০৬


'আসলে নেতারা প্রেম করলে হয় সিলেকশন নীতি, প্রেমে ছ্যাঁ'কা খাইলেই সেটা হয়ে যায় দুর্নীতি। তখন প্রেমকে মনে হয় স্বৈরতন্ত্র নীতি। মূলকথা সবই হলো রাজনীতি।'


★★

চৈত্রের ভার্সিটিতে জরুরি কাজ থাকার কারণে চন্দ্রার শ্বশুরবাড়ি থেকে ভোরবেলায় বাড়ি ফিরে আসে চিত্রণ ও চৈত্র। তবে চিত্রণের ধারণা ভুল হয়েছিল। 'মোড়ল বাড়িতে' থাকাকালীন রিপা আর বিশেষ বিরক্ত করেনি ওকে। তবে চিত্রণ ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বসময় পর্যন্ত ওর সঙ্গে জোঁকের মতো লেগে ছিল রিপা। 


___________


ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে চৈত্র। তবে

আজ ভার্সিটিতে মূলত ক্লাস করার জন্য যাচ্ছে না ও। লাইব্রেরীতে কিছু দরকারী কাজ আছে চৈত্রের। সুধাকে কল করে নিজেদের বাড়িতে আসতে বলেছে ও। দু'জনে একসাথে যাবে ভার্সিটিতে। 


★★

'ভাই, ওঠেন। ভাই?

মাঝরাতে রাণী মহলে ফিরেছিল দূর্জয়, নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবির সাহায্যে৷ ঘুমিয়েছে মধ্যরাতে। তাই আজ সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে ও। যদিও ভোর ছয়টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠা ওর নিত্যকার রুটিন। রাতুলের হালকা ঝাঁকানোতে ঘুম ভাঙে দূর্জয়ের। আধো চোখ মেলে একবার দেখে নেয় রাতুলকে। রাতুলের চেহারার হাবভাব দেখে ধারণা করে কোনো জরুরি ব্যস্ততা পড়েছে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠলো সেরনিয়াবাত। কোনো কথা না বলে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। 


'ভাই, প্রফেসর আজকেও আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনাকে নাকি কলও দিয়েছিল উনি। কিন্তু ফোনে না পেয়ে আমাকে কল করে বললো- আপনাকে জানাতে।'


অবুঝ দিনের ভালোবাসা (শেষ খন্ড) - গল্পকন্যা

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রাতুলের কথায় সাইড টেবিল হাতড়ে ফোন হাতে নিল দূর্জয়। দেখলো ফোন বন্ধ হয়ে আছে৷ বিরক্ত চিত্তে সেটা একটানে বিছানার মাঝ বরাবর ছুঁড়ে ফেললো। আজকে মেজাজটা কোনো বিশেষ কারণে চড়াও হয়ে আছে দূর্জয়ের। বিরক্তিতে "চ" উচ্চারিত হলো ওর মুখ হতে। দ্রুতপায়ে হেঁটে আলমারির নিকটে গেল। আলমারি থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি সেট বের করে ওয়াশরুমে চলে গেল।


কালো গেঞ্জি, ট্রাউজার এর খোলস ছেড়ে নিত্য দিনকার সাদা, শুভ্রতায় নিজেকে মুড়িয়ে নিলো সেরনিয়াবাত। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ায় মনোযোগী ছিলেন মাহাতাব সাহেব। তাকে বিদায় জানিয়ে, বাইকে রাতুলকে পেছনে বসিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের সাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। 


★★

নিজের রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চাকরির বিষয়ে একজন পরিচিত ব্যক্তির সাথে ফোনে কথা বলছিলো চিত্রণ। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চমকে ওঠে ও। পরমুহূর্তেই বিরক্ত হয়ে ফোনে কথা বলায় পুনঃমনযোগী হয়। 


কলিংবেল অনবরত বেজেই চলেছে। চিত্রণ ভেবেছিল অন্য কেউ গিয়ে দরজা খুলে দেবে। তবে এখনো কলিং বেল বেজে চলেছে, এতে বিরক্ত হয়ে নিজ রুম ছেড়ে ড্রয়িং রুমে আসে ও। মনে পড়ে, বাবা আজ মাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন ডাক্তারের কাছে। চৈত্র হয়তো ওয়াশরুমে আছে৷ কথাটা মাথায় আসতেই নিজেকে ধিক্কার দেয় ও ভুলো মনের জন্য। দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয় ও।


'কেমন আছেন চিত্রণ ভাইয়া?'

সামনে দন্ডায়মান সুধাকে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে চিত্রণ। অচকিতে স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে ওর আচরণ। ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলে-'কেমন আছি, সেকথা তোমাকে বলবো কেন? বান্ধবীর কাছে এসেছো, তার কাছে যাও। বান্ধবীর ভাই কেমন আছে সেসব জেনে কী কাজ!'


চিত্রণের কথা শুনে একবার ওর দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেলে মাথা নিচু করে সুধা৷ চোখের কোণে রুপালী অশ্রু চিকচিক করছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সুধা। তারপর দৌড়ে দোতলায় চৈত্রের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল ও। সুধার যাওয়ার পানে মিনিট কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চিত্রণ। কিছু একটা ভেবে হাতের মুঠো শক্ত করে ও। সিল্কি চুলগুলো হাতের সাহায্যে পেছনে ঠেলে দেয়। 


_________________


ভার্সিটিতে এসে প্রথমেই লাইব্রেরীতে প্রবেশ করেছে চৈত্র৷ একটা বই নিয়েছিল সে গত পরশু চারশত বাহান্ন পৃষ্ঠার বইয়ের শেষের কিছু পাতা নিখোঁজ। বইটা একদিনে পড়ে শেষ করেছে চৈত্র। শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে 'থ' হয়ে যায় ও। এতো দারুণ একটা বই অথচ শেষটা কী হয়েছিল, সেটা জানতে পারবে না! এক রাজনীতিবিদ নেতা এবং তার প্রেয়সী সুপ্রভার প্রেমকাহিনী, রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। নেতা অরুণ এবং তার প্রেমময়ী সুপ্রভার শেষ পরিণতি- তাদের সন্ধি হয়েছিল নাকি বিচ্ছেদ? এই প্রশ্ন চক্রের মাঝে আটকে গেছে চৈত্র। বইয়ের সমাপ্তি জানার প্রবল আগ্রহে আজ ভার্সিটির ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস রেখে বিশালাকায় লাইব্রেরীতে আসা ওর। লাইব্রেরীয়ান মমতাজ স্যার ইতিমধ্যে কৌতূহলী দৃষ্টিতে বেশ কয়েকবার দেখেছে ওকে। কারণ কখনো এতোটা প্রবল আগ্রহ নিয়ে একটা বইয়ের দ্বিতীয় আর কোনো কপি লাইব্রেরীতে এসে কেউ খোঁজ করেনি। যদিও একটা বইয়ের একই কপি লাইব্রেরীতে থাকে না সচারাচর। 


বইটির আর কপি খুঁজে না পেয়ে হতাশ চিত্তে বিশাল রিডিং টেবিলে বসে পড়ে চৈত্র। সামনে অবহেলার সহিত রাখা একটা বই তুলে নিয়ে ওলট-পালট করে দেখতে থাকে। এমন সময় কোথা থেকে হুট করে উদয় হয় তুলি। হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে দাঁড়ায় চৈত্রের পাশ ঘেঁষে৷ কোনোপ্রকার ভণিতা না করে চৈত্রকে বলে-

'আপা, এই কাগজে যা লেখা আছে হুবহু একই লেখা এই পৃষ্ঠায় একটু লিখে দাওনা।'

চৈত্রের হাতের মুঠোয় দুটো কাগজ ধরিয়ে দেয় তুলি। একটাতে কিছু লেখা, আরেকটা ফাঁকা। অর্থাৎ যেই কাগজটাতে লেখা রয়েছে, হুবহু সেরকম এই খালি কাগজে লিখতে হবে।


তুলিকে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা না করে রোবটের মতো লিখতে শুরু করে চৈত্র। বইটির জন্য পুরোপুরি অন্যমনস্ক, বিরক্ত সে। তাই তুলির কাজটা করে ওকে দ্রুত প্রস্থান করাতেই এহেন প্রশ্নবিহীন সাহায্য। নয়তো এতোক্ষণে শ'খানেক প্রশ্ন করে ফেলতো ও। চৈত্র কাগজের লেখাগুলো সমাপ্ত করতেই সেগুলো হাতে নিয়ে দ্রুত লাইব্রেরী ছেড়ে বের হলো তুলি। চৈত্র ঠায় বসে রইলো লাইব্রেরীর রিডিং টেবিলে।


★★

সবেমাত্র 'দ্য আলকেমিস্ট' বইয়ের প্রথম ছয় পৃষ্ঠা  শেষ করে সাত নম্বর পৃষ্ঠা উলটে পড়ার উদ্যোগ নিয়েছে চৈত্র। এমন সময় কতকগুলো ছায়ামূর্তি সামনে উদীয়মান হলো। ভ্রু কুঁচকে বই থেকে মাথা তুলে অবাক হলো চৈত্র। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তুরান ও নিশান। যমজ দুই ভাই, ভালো শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ষপূর্তি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পরপর দু'বছর দুটো বিভাগে প্রথম হওয়ায় মোটামুটি অনেকেই চেনে ওদেরকে। 

'চৈত্র, ল' ডিপার্টমেন্ট, থার্ড সেমিস্টার? এই একটাই তো চৈত্র আছে না এই তথ্য অনুযায়ী? আপনারে ভাই ডাকতেছে। চলেন আমাদের সাথে।'


মেজাজ আগে থেকেই হালকা বিগড়ে ছিল চৈত্রের। তুরানের তক্ষক কথাবার্তায় আ'গুনে যেন ঘি পড়লো! তীক্ষ্ণ কন্ঠে, চড়া গলায় বললো-

'দেখো, তোমরা আমার জুনিয়র। তাই বলছি, কোনোপ্রকার ফাজলামো অথবা র‌্যা'গিং করার উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে যদি এসে থাকো তবে ব্যাপারটা তোমাদের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।  আমার নাম জানো যখন তাহলে নিশ্চয়ই এতটুকুও জানা আছে- গোটা ভার্সিটিতে 'গু'ন্ডি' সনদ প্রাপ্তি রয়েছে আমার। আজ পর্যন্ত যেক'টাকে মে'রেছি সবগুলোই হাসপাতাল নামক শ্বশুরালয় থেকে ঘুরে এসেছে৷ জুনিয়র বলে বলছি, নিজেদের ভালো চাও তো চোখের সামনে থেকে এক্ষুণি বিদায় হও!'


চৈত্রের কাটকাট কথায় তুরান ভয় পেল খানিকটা। ঘাবড়ে যতটা সাহস নিয়ে চৈত্রের সামনে এসেছিল, তার থেকেও দ্বিগুণ ভয়ে সিঁটিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল ও। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। না, লাইব্রেরীতে লোকসংখ্যা অল্প। ওদের দিকে তেমন লক্ষ্য নেই কারো। নিশান ক্ষণিক সাহসের সহিত এগিয়ে আসলো।

'দেখেন চৈত্র আপা। আমাদেরকে চেনেন যখন, অবশ্যই এটাও জানেন আমরা নিতান্তই ভদ্র স্বভাবের। কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই আমাদের নামে। আমরা এখানে কোনোরকম ফাজলামি করতে আসিনি। আমাদের নেতা ডেকে পাঠিয়েছে  আপনাকে। এমনিতেও আপনি যে কান্ড বাঁধিয়েছেন! আজকে আপনি শেষ! গেলেন!'


তুরান ও নিশানের কথাগুলো যেন সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে চৈত্রের। আশ্চর্যের চরম সীমায় উপনীত হলো। কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলে বললো-'কী কান্ড বাঁধিয়েছি আমি?! কোন ভাই, নেতা ডেকে পাঠিয়েছে আমাকে? কীসব বলছো তোমরা!'


'গরু খায় ঘাস-পাতা,

 ছাগলে খায় আতা,

দূর্জয় ভাই আমাদের নেতা।'

'আপনাকে ডেকেছেন তিনি।'


তুরান ও নিশানের একত্রে বলা স্লোগানটা শুনে মিনিট দুয়েক স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে রইলো চৈত্র। অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো ওদের দিকে। বিরবির করে স্লোগানটা ধীরে ধীরে রিপিট করলো।

'গরু খায় ঘাস-পাতা,

.. ছাগলে খায় আতা,

দূর্জয় ভাই আমাদের নেতা!'


চরম মেজাজপূর্ণ মূহুর্তেও স্লোগানটা রিপিটের পরে ফিক করে হেসে উঠলো চৈত্র। পরমুহূর্তেই মুখে কপট গাম্ভীর্যতা বিরাজমান রেখে বললো-

'এই ছেলে! তোমরা না বাংলা বিভাগের ছাত্র? তাহলে এরকম অর্থবিহীন, শ্রীহীন স্লোগান কীভাবে তৈরি করলে! এই স্লোগান শুনে তো তোমাদের নেতাকে আমার আতা মনে হচ্ছে।'


পুনরায় আবারও হেসে ওঠে চৈত্র। ওর মৃদু হাসির ঝংকার ছড়িয়ে পড়ে প্রতিধ্বনিত হয় পুরো সুবিশাল দোতলা বিশিষ্ট লাইব্রেরী জুড়ে। 


চৈত্রের কথায় ভাবনায় পড়লো তুরান ও নিশান। হাবাগোবা ভঙ্গিতে তাকায় ওর দিকে। 

'আসলে আমরা এতো ভেবে স্লোগান তৈরী করিনি। যা মাথায় এসেছিল, সেটাই বানিয়ে দিয়েছি৷ এটা আমাদের পারমানেন্ট স্লোগান।'

আলাভোলা ভাবে তুরান বলে।

'তোমাদেরকে আমি একটা শ্রীযুক্ত স্লোগান তৈরী করে দেবো পরে। এখন চলো। দেখি তোমাদের আতা নেতা কেন ডেকেছেন আমাকে। কী এমন কান্ড বাঁধিয়েছি আমি!'


_______________


তুরান ও নিশানকে অনুসরণ করে বটতলায় এসে দাঁড়ালো চৈত্র। হাত ছয়েক দূরত্বে বিমূর্ত, গম্ভীর ভঙ্গিমায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয় সেরনিয়াবাত। তার আশেপাশে ঘিরে রয়েছে প্রায় দশ-বারোজন ছেলে-মেয়ে। ছেলেগুলো সবাই সম্ভবত ছাত্রলীগ কর্মী। মেয়েদের মধ্যে একজনকে হালকা-পাতলা চেনে চৈত্র। মেয়েটার নাম শিলা। বছর তিনেকের সিনিয়র। ছাত্রনেত্রী সে। তুরান ও নিশানের ইশারায় সবাইকে পাশ কা'টিয়ে সোজাসাপ্টাভাবে দূর্জয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো চৈত্র। সম্পূর্ণ নিজ, স্বাভাবিক ভঙ্গিমায়। সবার দৃষ্টি সহসা চৈত্রের ওপরে পড়লো। এমন হাবভাব যেন ওর অপেক্ষায় ছিল সবাই। চৈত্রকে দেখে বিমূঢ়তা ভাঙলো সেরনিয়াবাতের। গাম্ভীর্যতার সহিত স্ট্যান্ড করে রাখা বাইকে আড় হয়ে বসলো ও। ইশারায় চৈত্রকে এগিয়ে আসতে বললো। কৌতূহলী চৈত্র বুকে হাত গুঁজে সামনে এগোলো। নিরবতা কাটিয়ে সেরনিয়াবাত চৈত্রের হাতে একটা সাদা কাগজ ধরিয়ে দিলো। এবড়োথেবড়ো ভাবে মুচড়ে রাখা কাগজটার দিকে ইঙ্গিত করে গম্ভীর স্বরে বললো-

'এই কাগজে যা লেখা আছে, সম্পূর্ণটুকু পড়বে। একটা শব্দেও যেন বাদ না যায়!'


সেরনিয়াবাতের কন্ঠে কী ছিল কে জানে! তবে চৈত্র কোনোপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে মুচড়ানো কাগজটা খুলে ভেতরের লেখাগুলো টেনে টেনে পড়া শুরু করলো।

.

ডিয়ার নেতাসাহেব,

আপনি এত্তো কিউট কেন বলুন তো! আপনার ঐ ঈগল চোখের প্রেমে পড়ে কতবার ম'রেছি আমি!  জানেন? আপনার এটিটিউডে আমি ফিদা হয়েছি। সাদা পাঞ্জাবি পড়লে পাক্কা একটা রসগোল্লা মনে হয় আপনাকে। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে বলে দিন কবুল। কাজী ডেকে আনার দায়িত্ব আমার। আমার বাবুর কিউট আব্বু বানাবো আপনাকে। আপনি হবেন আমার বাবুর কিউট রসগোল্লা আব্বু!'


ইতি 

আপনার প্রেমে পিছলে পড়া এক নাবালিকা।


.চৈত্র, ল' ডিপার্টমেন্ট, থার্ড সেমিস্টার!


শেষটুকু পড়ে থ' হয়ে রইলো চৈত্র! চিঠির হাতের লেখা ওর। তথ্য ওর! বুঝলো চরমভাবে ফেঁসে গেছে ও। তবে এই চিঠি যে ও সজ্ঞানে লেখেনি সেটা কী করে এখন বুঝাবে এই নেতাসাহেবকে!


আপনি পড়ছেন একটি রাজনৈতিক শিক্ষনীয় গল্প

পর্ব সংখ্যা ০৭


শেষটুকু পড়ে থ' হয়ে রইলো চৈত্র! চিঠির হাতের লেখা ওর। তথ্য ওর! বুঝলো চরমভাবে ফেঁসে গেছে ও। তবে এই চিঠি যে ও সজ্ঞানে লেখেনি সেটা কী করে এখন বুঝাবে এই নেতাসাহেবকে!


চৈত্র চিঠিটুকু পড়ে শেষ করা মাত্রই তড়িৎ গতিতে বাইক থেমে নেমে দাঁড়ালো সেরনিয়াবাত৷ ওর বুক বরাবর মাথা পড়ে চৈত্রের৷ অস্বস্তিতে খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়ায় চৈত্র৷ ভবিষ্যৎ প্রশ্নের জবাব দিতে একদমই প্রস্তুত নয় সে। তবুও নিজেকে যথাযথ শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। ছাত্রনেত্রী শিলা চৈত্রের ডানপাশে এসে দাঁড়ালো। দূর্জয় কিছু বলার আগেই চৈত্রের কানে ফিসফিস করে শিলা বলে ওঠে-

কিভাবে আপনার সাইবার সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন? বিস্তারিত জানুন।

'কী গো মেয়ে? আমাদের নেতার প্রেমে পড়লে নাকি? যে প্রেমপত্রও লিখে ফেলেছো! আজকে তুমি শেষ!'

'তবে প্রেমপত্র যদি তুমি নেতাকে না দিয়ে টাকলা প্রফেসর সাত্তারকে দিতে, তবুও কাজ হতো বোধহয়। বৃথা চেষ্টা, ইশশ!'


শিলার কন্ঠস্বরে বোধহয় তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ পেলো। চৈত্র ভ্রু কুঁচকে একবার দেখে নিল শিলাকে। স্টাইলিশ জিন্স, শার্ট পরিহিত। পোশাক-আশাকে শিলা মেয়েটাকে মোটামুটি মানের 'বেয়াদবে' আখ্যায়িত করলো চৈত্র। 

'এই মেয়ে, তুমি নাবালিকা?! বয়স কতো তোমার? বিশের ওপরে হবে অবশ্যই। নিজেকে কোন হিসেবে নাবালিকা দাবি করো তুমি?'


দূর্জয়ের চিৎকারে ঈষৎ কেঁপে উঠলো চৈত্র। এতগুলো মানুষের ভীড়ে নিজেকে যেন অথৈ পাথারে আবিষ্কার করলো ও। মনে মনে দূর্জয়কে একরাশ কথা বলে ফেললো। 

'এরকম ষাঁড়ের মতো চেঁচানোর জন্য আপনাকে ভবিষ্যতে যদি কখনো নির্বাচনে দাঁড়ান, তখন যেন ব'দনা মার্কা দেওয়া হয়। আতা নেতা!'

'গরু খায় ঘাস-পাতা,

ছাগলে খায় আতা।

দূর্জয় সেরনিয়াবাত ব'দনা মার্কা নেতা!'


মনে মনে কথাটুকু আওড়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে আচনক হেসে ওঠে চৈত্র। ওর এহেন হাসিতে উপস্থিত সকলে অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। 

'বে'হায়া মেয়ে! এমন বিচ্ছিরি কথাবার্তা যুক্ত চিঠি লিখে আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছো! শিক্ষা-দীক্ষা নেই নাকি কিছু?'


'কী আর হবে? এর ভাইটা যেমন ল'ম্পট। বোনটা তেমনই বে'হায়া।'


শিলার কথার পিঠে এতোটুকু বলতেই মূহুর্তের মধ্যে ঠাস করে একটা থা'প্পড় পড়লো মুহিতের গালে। স্তব্ধ মুহিত গালে হাত দিয়ে সামনে তাকালো। হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে চৈত্র। রাগে মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে ওর। কপট চেঁচিয়ে মুহিতের উদ্দেশ্যে বললো-

'সিনিয়র হিসেবে যদিও বা মাফ পেতেন, তবে আমার ভাইয়ের সম্বন্ধে কেউ কোনো কটুকথা বললে তাকে মোটেও ছাড় দিইনা আমি। আপনি কোন সাহসে আমার ভাইকে এমন সম্বোধন করেছেন? এই থা'প্পড়টা প্রাপ্য ছিল আপনার।'

'মেয়েমানুষকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করার চেষ্টা করে হয়তো এর আগে সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আমি সেসব মেয়েদের মতো নই যে, নিজের অপমান হতে দেবো। হাসতে- হাসতেও মানুষকে থা'প্পড় মেরে দিতে পারি। এই যেমন আপনাকে উপহার দিলাম মাত্র।'


কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে রাতুলের গালেও একটা থা'প্পড় পড়ে। নেকিয়ে রাতুল চৈত্রের উদ্দেশ্যে বলে-

'যা বলার, সেসব তো আপনাকে ভাই আর মুহিত ভাই বলছেন। থা'প্পড় আমার গালে কেন পড়লো বড় আপা?!"

'মুহিত যা বলেছেন, বীপরীতে তার বরাবর হিসাব পেয়ে গেছেন। তোমাদের নেতার জন্য থা'প্পড়টা তোমাকে দিলাম৷ তাকে বুঝিয়ে দিও, কীভাবে কথা বলতে হয় মানুষের সাথে। সে আবার শ্রদ্ধেয়-সম্মানীয় ব্যক্তি কিনা! এজন্য সম্মান দেখিয়ে গালে হাত দিলাম না। তোমাকে দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম থা'প্পড়টা মূলত তারই প্রাপ্য।'


মেজাজ তুঙ্গে উঠিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল চৈত্র। ওর যাওয়ার দিকে নিস্ক্রিয় দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো সেরনিয়াবাত। পরমূহুর্তেই আবারো মুহিতের গালে আলগোছে থা'প্পড় পড়লা। বিস্ময়ে বিমূঢ় মুহিত দূর্জয়ের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। তবে নিজের রাগকে কঠিন চেষ্টায় দমন করে নিল। যেন কিছুই হয়নি। 

'তুই আজকে একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে করে ফেলেছিস মুহিত। যেখানে আমি আছি, তোদের সেখানে বাড়তি কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই।'


'আজকে হচ্ছে কী আমার সাথে? সকালে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম যে, থা'প্পড়ের পর থা'প্পড় খেয়েই চলেছি!'

মনে মনে কথাটা আওড়ে মুহিতের চোখ জ্বলে উঠলো কপটতায়।

'দূর্জয় তুই ঐ মেয়েটাকে কিছু বললি না কেন? আমি খেয়াল করেছি- আজ অবধি যে কয়বার ঐ মেয়েটার সাথে তোর দেখা হয়েছে, সেটা কোনো না কোনো গন্ডগোলের মাধ্যমে। প্রত্যেকবার দোষ করেছে ঐ মেয়েটা। অথচ অবাক করা ব্যাপার হলো- তুই ওকে তেমন কিছুই বলিসনি! যদিও তোর সেই ক্ষমতা আছে।'

মুহিতের কথায় হালকা হাসলো সেরনিয়াবাত। প্রাণ উজাড় করা হাসি।

'শোন মুহিত। সব জায়গায় নিজের ক্ষমতার জাহির করতে নেই।'

'এই দূর্জয় সেরনিয়াবাতের ধৈর্য, সহ্যশক্তির সীমানা প্রাচীর অনেক ঊর্ধ্বে। এটা পার করার সাধ্য সহসা কারো নেই৷ এমনকি ওই সামান্য মেয়েটারও নয়!'


পিছিয়ে দাঁড়ায় মুহিত। সবার থেকে কিছুটা দূরে। ফিসফিসিয়ে বলে-

'তোর ধৈর্যের বাঁধ কোথায় গিয়ে ভাঙতে পারে সে বিষয়ে আমার খুব ভালোভাবে জানা আছে দূর্জয় সেরনিয়াবাত। অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা৷ এই দাবার গুটিকে আমি ঠিক সামনে এগিয়ে দেবো। তখন তোর ধৈর্য কোথায় থাকে দেখবো। তোর এই অতিরিক্ত ধৈর্যের জন্যই আমার কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছে না। যদিও আমি কিছুটা হলেও সফল।'


____________________


'তুলি, এই তুলি।'

তিনতলা দ্বিতীয় ভবনবিশিষ্ট হোস্টেলর মাঝারি সাইজের তেরো নম্বর রুমে প্রবেশ করেই চিৎকারের সাথে তুলিকে ডাকে চৈত্র। ওর হঠাৎ এভাবে ডাকার কারণে বিছানা ছেড়ে পরতে পরতেও উঠে দাঁড়ায় তুলি। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো চৈত্রের সামনে। রুমের বাকি মেয়েরা চৈত্রের রাগান্বিত, ঘর্মাক্ত মুখের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে ব্যাপারটা বোঝার জন্য।

'কী হয়েছে চৈত্র আপা? তুমি এতো রেগে আছো কেন? কেউ কিছু বলেছে নাকি?'

ভাব - রিয়াজ রাজ

তুলির প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না চৈত্র। ওকে টেনে বিছানায় বসায়। নিজেও পাশে বসে পড়ে। হাতের মুঠোয় কঠিনতার সহিত অবস্থান করতে থাকা মুচড়ানো কাগজটা তুলির সামনে তুলে ধরলো চৈত্র। কর্কশ স্বরে বললো-'এসব কী তুলি?'

কাগজটা দেখে চমকে উঠলো তুলি।

'তুমি এই চিঠিপত্র কোথায় পেলে চৈত্র আপা? এটা তো আমি নেতাসাহেবকে দিয়েছিলাম।'


নড়েচড়ে বসে চৈত্র। তারমানে সে সঠিক ধারণা-ই করেছিল।

'আরেকটা কাগজে যা লেখা ছিল তুই সেসব লিখতে বলেছিলি আমাকে। সেই মোতাবেক একই কথা আমি এই কাগজটাতে লিখেছি। তবে একটা ভুল করে ফেলেছি। অন্যমনস্কতায় সবসময়কার মতো এই কাগজে নিজের ডিটেইলস লিখে ফেলেছিলাম। ওই নেতা আর তার লোকেরা ডেকে নিয়ে হ্যারাস করেছে আমাকে। বিষয়টা কতোটা অপমানজনক তুই বুঝতে পারছিস তো তুলি?!'


তুলির কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো চৈত্র। ওর এহেন কঠোর জিজ্ঞাসাবাদে ঘাবড়ে যায় তুলি। আমতা-আমতা করে বলে ওঠে-

'আমি নেতাসাহেবকে ভালোবাসি আপা। তাই তাকে নিজের মনের কথা জানানোর জন্য চিঠি দিতে চেয়েছিলাম। তুমি তো জানো- বরাবরই আমার হাতের লেখা খুব খারাপ। যেহেতু তোমার লেখা ভালো, তাই তোমাকে দিয়ে লাভ লেটার লিখিয়েছি। তুমি লিখে দেওয়ার পরে আমি কাগজটা ভাঁজ করে, টুনাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলাম নেতাসাহেবের কাছে। ওকে তো বলেছিলাম, নেতাসাহেবকে আমার নাম বলে চিঠি দিতে।'

'এই টুনা তুমি নেতাসাহেবকে আমার নাম বলেছিলে তো?'

বিছানার এককোণে বসে ছিল টুনা। তুলির প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকায় টুনা। মনে করার চেষ্টা করে।

'সরি তুলি। আমি তোমার নাম বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। দূর্জয় সেরনিয়াবাতকে দেখেই ভয়ে ঘাবড়ে ছিলাম। তাই তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের হাতে দিয়ে এসেছিলাম চিঠিটা।'


টুনার কথায় তুলি ঘেমে-নেয়ে একাকার। আতঙ্কিত চোখে চৈত্রের দিকে আড়ে তাকায় ও। যা ভেবেছিলো ঠিক তা-ই হয়েছে। চৈত্র অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই চোখের ভাষা বেশ ভালোভাবে জানা আছে তুলির। ভয়ংকর রেগে আছে চৈত্র। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে তুলি-

'অনেক বড় মিস্টেক হয়ে গেছে চৈত্র আপা। আর জীবনেও এমন ভুল হবে না। সরি আপা।'


চৈত্র কোনো প্রতিত্তোর করে না। হঠাৎ তুলির বাহু ধরে টেনে দাঁড় করায় ওকে। অত্যাধিক ধারালো কন্ঠস্বরে তুলির উদ্দেশ্যে বলে-

'তুই এখন আর ষোলো বছরের খুকি নয় তুলি। এসব কী ন্যাকা কথা লিখেছিস তুই চিঠিতে! নাবালিকা তুই?! এখনো সময় আছে, কল্পনার জগৎ থেকে বের হ্ তুলি। বাস্তবতায় ফিরে আয়। আমাদের জীবনের বাস্তবতা গুলো বড্ড কঠিন হয়। তুই যে ঐ নেতাকে চিঠি দিয়ে নিজেকে ছোট করেছিস, এটা বুঝতে পারছিস তো? বল৷ বুঝতে পারছিস? ঠিকঠাক মতো পড়াশোনা করে নিজেকে বড় করার চেষ্টায় রত থাক, এসব চিঠিপত্র লিখে নয়!'

'তুই আমার নামও জড়িয়েছিস তুলি। বিলিভ মি, এতে আমার মারাত্মক অপমান হয়েছে। আমার বড় ভাইয়ের সম্পর্কে বাজে কথা শুনতে হয়েছে। যেরকমটা আমার ভাইয়া কোনোদিনই না।'


'চৈত্র আপা বলছি তো সরি। এবার থামো না প্লিজ। তোমার মুখ থেকে এমন কঠোর কথা শুনে আমার কান্না পাচ্ছে।'

জড়ানো গলায় বললো তুলি। 

'আমারও কষ্ট হয়েছিল তুলি, যখন ওরা আমাকে, আমার ভাইকে বাজে কথা বলে অপমান করেছিল। যাইহোক একটা ভুল হয়েছে, এটার প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার। তুই এখন দূর্জয় সেরনিয়াবাতকে গিয়ে সবকিছু খোলাসা করে বলবি।'

'কিন্তু চৈত্র আপা..'

'আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাই না তুলি। বড় বোন হিসেবে তোকে আদেশ দেওয়ার অধিকারটুকু নিশ্চয়ই আমার আছে?'


তুলি বেশ ভালোভাবে বুঝে গেছে- চৈত্র নাছোড়বান্দা। এই ঘটনার সমাপ্তি না দেখে সে ছাড়বে না। অগত্যা অপরাগতায় বাধ্য হয়েই অবাধ্য পায়ে রুম ছেড়ে বের হলো তুলি। ওর যাওয়ার উদ্দেশ্য পাঁচ মিনিটের পথ হেঁটে নজরুল হলের পেছন দিককার বিশাল বটতলা। দূর থেকে ছোট ছোট অবয়বগুলো যতই স্পষ্টতর হচ্ছে তুলির বুকের বামপাশে অবস্থান করা ছোট্ট হৃদয়ের টুকরোটা যেন ততই লাফিয়ে জানান দিচ্ছে নিজের ভয়াবহ পরিস্থিতি।


'নেতাসাহেব?'

তুলির ঈষৎ অস্পষ্ট ডাকে ভ্রু কুঁচকে পেছনে ফিরে তাকালো দূর্জয়। জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টি ফেললো তুলির দিকে। যার অর্থ-"কী চাই?"

তুলি বোধহয় বুঝতে পারলো। তাই গুরুতর সাহস জুগিয়ে মাথা নিচু করে একনাগাড়ে বলতে লাগলো-'কিছুক্ষণ আগে আপনি যেই চিঠিটা পেয়েছিলেন দূর্ভাগ্যবশত ঐটা আমার দেওয়া৷ চৈত্র আপা দেননি৷ সে শুধুমাত্র চিঠি লিখতে আমাকে সাহায্য করেছিল৷ তবে এই চিঠি দেওয়ার ব্যাপারে সে কিছুই জানতো না৷ জানলে ভুলেও আমাকে এই চিঠি লিখে দিতো না। একটু দুশ্চিন্তায় থাকার কারণে ভুলবশত চিঠিতে নিজের  ডিটেইলস লিখে ফেলেছে আপা। আমিও না দেখে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছি আপনাকে৷ একটা ছোটখাটো মিস্টেক হয়ে গেছে এখানে। চৈত্র আপার কোনো দোষ নেই।'

জোরে নিশ্বাস নিয়ে থামে তুলি। আড়ষ্টতায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। ওকে দেখে তুরান নিচু স্বরে বলে ওঠে-'চোখ বন্ধ করলে মেয়েদেরকে এতো সুন্দর লাগে! আগে জানতাম না তো।

মেধাবী ছাত্র হবার বৈজ্ঞানিক কৌশল | অধ্যায়-০১ঃ প্রতিভাবানদের ছেলেবেলা
তোমাকে দেখেই বুঝতে পারলাম।'


আপনি পড়ছেন রাজনীতি গল্পের লিংক

পর্ব সংখ্যা ০৮

-'চোখ বন্ধ করলে মেয়েদেরকে এতো সুন্দর লাগে! আগে জানতাম না তো। তোমাকে দেখেই বুঝতে পারলাম।'


'ভবিষ্যতে কখনো যেন এধরনের ফাজলামি আর না দেখি!'


তুলিকে কঠোরতায় এর থেকে বেশি কিছু বলেনা দূর্জয়। কিছুক্ষণ তুলির দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ইশারায় চলে যেতে বলে ওকে। দূর্জয়ের স-সম্মতি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন তুলি। ওকে কিছু বলেনি, এজন্য মনে মনে খুব খুশি অনুভূত হয় ওর। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মনে পড়ে, কিছু একটা মিস হয়ে গেছে। হয়তো কিছু বলা বাকি ছিল দূর্জয়কে। তুলি বিরবির করে-

'চৈত্র আপা বলেছিল নেতাসাহেব আমার বাপের বয়সী। ভুল কিছু বলেনি।'


পিছিয়ে আবারো দূর্জয়ের সামনে পুনঃ দাঁড়ালো তুলি। মিশমিশে গলায় বললো,

'চৈত্র আপা বলেছিল আপনি আমার বাপের বয়সী। মাফ করবেন বাপ! আর জীবনেও এরকম ভুল হবে না বাপ। এবার থেকে আপনাকে আমি বাপ সম্বোধন করবো।'


এহেন খাপছাড়া কথাতে ভ্রু কুঁচকে, অক্ষিপট মিয়মান করলো সেরনিয়াবাত। তৎক্ষনাৎ প্রস্থানপর হলো তুলি। সে নিজেও জানে না কোন এক অদ্ভুত, অদৃশ্য সম্মোহনী শক্তির প্রভাবে সে এমন দুঃসাহসিক একটা কথা বললো। যদিও এহেন কথার বিপরীতে দূর্জয়ের যে আচরণ করা উচিত ছিলো, সম্পূর্ণ বিদ্রোহী আচরণ পাওয়া গেছে ওর তরফ থেকে।


__________________


আজ বাড়িতে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে সোজা রুমের সাথে লাগোয়া মিনি ছাঁদে চলে গেছে চৈত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পর থেকে মন-মেজাজ বিগড়ে আছে ওর। যদিও বিষয়টার নিষ্পত্তি ঘটেছে!


অনিমা বেশ কয়েকবার খেতে ডেকেছিলেন চৈত্রকে। তবে খাওয়ার ব্যাপারে ওর তেমন বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ পায়নি। 

'মা, তুই এখানে এলোচুলে বসে আছিস কেন? মন খারাপ?'

দুই হাত মুখে গুঁজে, ঘন চুলের গোছা এলিয়ে অপরাহ্নের মিঠা সোনালি রোদ গায়ে মেখে টুলে বসে ছিল চৈত্র। মায়ের হঠাৎ পিছুডাকে চমকে উঠলো চৈত্র। পরক্ষণে আরেকটা টুল এগিয়ে বসতে দিলো অনিমাকে। টুলে চৈত্রের মুখোমুখি বসলো অনিমা। চোখে প্রখরতা। কন্ঠে তেজস্বতা নিয়ে বললো-

"খাবার খেলি না যে! তোর কী হয়েছে? মন খারাপ কেন আম্মা?"

'কোথায়? কিছু তো হয়নি মা।'

'মা হই আমি তোর! মেয়ের মুখ দেখলেই সব বুঝে যাই৷ এখন আমাকে খোলাসা করে বল তোর কী হয়েছে।'

'মা, আমার কী..'


'রজ্জ, ও রজ্জ। কোথায় তুই?'

'তুই এখানে! আর সারা বাড়িতে তোকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি!'


রুম ডিঙিয়ে মিনি ছাঁদের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে কথাটুকু বলে হাঁপাতে থাকে চিত্রণ। ওর এমন অবস্থা দেখে অনিমা এবং চৈত্র, দুজনেই ভীষণ অবাক হয়।

'কী হয়েছে চিত্রণ? তুই এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? কোথায় আবার কী বাঁধিয়ে আসলে ঝামেলানান্দ?'


'মা, আমার এখন কথা বলার এক সেকেন্ডও সময় নেই। চৈত্র দ্রুত চলে আয়৷ নিচে আমার বাইক রাখা আছে। বাইকে উঠে পড়লে, পৌঁছাতে দশ-পনেরো মিনিট৷ হ্যাঁ হয়ে যাবে।'


'কী হয়েছে? কী হয়ে যাবে? কিছুই তো বুঝছি না!'


'জমাদ্দার চাচার গোডাউনগুলোতে আ'গুন লেগে গেছে মা। আমি রজ্জকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি ওখানে৷ যদি কিছু সাহায্য হয় ওদের।'


'চৈত্র! ও কী করবে ওখানে গিয়ে?! আ'গুন নেভানোর জন্য তো ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আছে। আমার মেয়েকে কোথাও পাঠাবো না।'


'গোডাউনের পাশেই দাস পাড়া। সেখানকার ঝুপড়ি কিছু ঘরেতেও আ'গুনের আঁচ লেগেছে। ধীরে ধীরে আ'গুন মানুষের বাড়িঘরেও ছড়িয়ে পড়ছে মা। ভয়ানক অবস্থা! লক্ষ করে দেখো, ভালোভাবে খেয়াল করলেই দেড় কিলোমিটার দূরের আ'গুনের ধোঁয়াও এখান থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে।'


ছেলের কথায় পুব আকাশে ভালোভাবে খেয়াল করলেন অনিমা। আসলেই তো! ধোঁয়া, লাল লেলিহান দাবানলের ন্যায় শিখা আকাশের আনুমানিক দেড়-দুই হাজার ফুট ওপরে স্পষ্ট হচ্ছে! এতক্ষণ তিনি এবং চৈত্র কেউ-ই বুঝতে পারেনি। মিনিটে মিনিটে আ'গুনের শিখা বেড়েই চলেছে! অজানা আতঙ্কে ভয় পেলেন অনিমা। দ্রুত চৈত্রের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলেন ওকে।

'না, না। ওকে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ তুই ছেলেমানুষ। সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করতে পারবি। নিজেকে আ'গুন থেকে সতর্ক রাখতে পারবি। কিন্তু চৈত্রকে আমি ওখানে কোনোভাবেই পাঠাবো না। অসম্ভব!'


'মা ওর একটা স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠন আছে। ও চাইলেই অন্তত সবার ঘরের জিনিসপত্র গুলো বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে কেন যাবে না ও?!'


চিত্রণ হতাশ হয়ে ফিরে আসে। দোতলা পেরিয়ে মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে একটি কোমল হাত ওর বাহু জড়িয়ে ধরে। চিত্রণ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে - চৈত্র দাঁড়িয়ে আছে। 

'ব্রাদার, জননীকে আমি ম্যানেজ করে এসেছি৷ চিন্তা করো না। চলো, যাওয়া যাক দ্রুত। সময় বেশি নেই৷ আকাশের অবস্থা দেখেছো! আগু'নের ধোঁয়া, শিখার প্রভাবে এই সোনালী বিকালেই কালো আঁধার নেমে এসেছে পৃথিবীতে।'


আর কোনো কথা বলার সুযোগ হয়না। ভাই-বোন বাইকে উঠে গন্তব্যস্থল- দাস পাড়ার পেছন ঘেঁষা গোডাউনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো৷ দুজনেরই একই মনোভাব_অন্তত কিছু না হোক, কারো সহায়সম্বল বাঁচাতে যদি সাহায্য করতে পারে!


__________________


'ভাই, দূর্জয় ভাই। বাসায় আছেন? থাকলে জলদি বাহিরে আসেন।'


সবেমাত্র ড্রয়িংরুমের বিশাল ডাবল সোফায় আধশোয়া হয়ে বড় এলইডি টিভিতে পলিটিক্যাল নিউজ উচ্চমগ্ন হয়ে দেখেছিল দূর্জয়। রিমোট হাতে নিয়ে দ্রুত টেলিভিশন অফ করে ও। বারান্দায় এসে দেখে এলাকার-ই ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক 'পিন্টু হাওলাদার বাইট্টা' দাঁড়িয়ে আছে কোমরে হাত গুঁজে৷ বিশেষ প্রতিক্রিয়া নয়, তবুও বিশেষ।

'কী হয়েছে পিন্টু? হাঁপাচ্ছিস কেন? ভেতরে আয়৷ শান্তভাবে বসে পানি খেয়ে নে আগে।'

'ভাই শিগগির চলেন। বিরাট দু'র্ঘটনা ঘটে গেছে৷  নদীর পাশে পোড়োমাঠের কাছ ঘেঁষে যেই গোডাউনগুলো আছে না? তাতে আ'গুন লাইগা গেছে। পরিস্থিতি ভয়ানক৷ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সবাই এখনো আইসা পৌঁছায় নাই। সাধারণ জনগণ দূর থেইকা দাঁড়ায় দেখতাছে শুধু।'


'এতো বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ আমি জানি না! পিন্টু তুই বাইক স্টার্ট দে। এখনই চল।'


তড়িঘড়ি করে বারান্দা ছেড়ে গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায় সেরনিয়াবাত। কিছু একটা মনে পড়তেই আবারো রাণী মহলে প্রবেশ করে ও। স্কাই-ব্লু গ্লাসের টেবিল হাতড়ে ফোন আর বাইকের চাবিটা উঠিয়ে নেয় ও। কল করে কাউকে কিছু একটা বলে। দ্রুততার সাথে বের হতে যাবে তখনই সামনে পড়ে তোশা।

'এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছো ভাই? সচারাচর এসময়ে তো তুমি কোথাও বের হও না।'

'পোড়োমাঠের গোডাউনে আ'গুন লেগেছে। আমি সেখানেই যাচ্ছি বৌমণি৷ তুমি মাকে বলে দিও। আবার যেন চিন্তা না করে!'


অবুঝ দিনের ভালোবাসা (প্রথম খন্ড) - গল্পকন্যা
তোশাকে মোটামুটি বুঝিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো দূর্জয়। পকেট থেকে ঈগল পাখির মেটালে তৈরি সংযুক্ত চাবিটা বের করে অতি দ্রুততার সমন্বয়ে।


'ভাই আপনের পরনে তো খালি সাদা লুঙ্গি আর গেঞ্জি। পোশাক চেঞ্জ কইরা নেন! ওইখানে তো সাংবাদিকরা-ও থাকবো। পত্র-পত্রিকায়, সংবাদমাধ্যমে আপনার ছবি আইবো! একটু ফিটফাট হইয়া নেন।!'


বাইক স্টার্ট দিতে দিতে পিন্টুর কথায় কপালের শিরা ফুলে ফেঁপে ওঠে দূর্জয়ের। কপোল হলদেটে করে, নীল শিরা সমৃদ্ধ ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে বলে-

'আমি একটা দুর্ঘটনাস্থলে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে যাচ্ছি পিন্টু। কোনো এওয়ার্ড ফাংশনে নয়। এই পোশাকেই যাবো আমি। আর কোনো কথা বলবি না। চুপচাপ বাইক স্টার্ট দে। এমনিতেই লেট হয়ে গেছে৷ না জানি, ওদিকে কী হচ্ছে!'


_____________________


ও মাসি, তোমরা একটু পানির ব্যবস্থা করো। ঘরের মধ্যে যত বালতি, কলস আছে সব নিয়ে আসো। পানির পাইপ লাইন তো চালু করা সম্ভব হবে না। মূলকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তোমরা বরং নদীর ঘাটে নেমে পানি নিয়ে আসো। অন্তত তোমাদের ঘরবাড়ি তো বাঁচাতে হবে নাকি!' 

'এভাবেই হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে? মনোবল আনো। অবশ্যই পারবে তোমরা৷ কয়েকজন মিলে ঘরে থাকা জিনিসপত্র বের করে গলির বাইরে নিয়ে যাও। শুনলাম ওই পাশের দেওয়ালটা আ'গুনের তাপে ভেঙে পড়েছে। এদিকটা-ও বেশ রিস্কে আছে।'


দাস পাড়ার মধ্যে আপাতত অবস্থান করছে চৈত্র। চিত্রণ নেই এখানে৷ সে ওপাশে গিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সাথে। চৈত্রের নারী স্বেচ্ছাসেবী দল__'জাগরণ' ইতিমধ্যেই আপডেট জেনে চলে এসেছে৷ কেউ এসেছে স্কুটারে করে, আবার যাদের বসবাস শহর থেকে দূরে তারা এসেছে পাঠাও-য়ের গাড়িতে চড়ে। মোট তেরো জন নারী স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে 'জাগরণ' সংগঠন। চৈত্র তাদের মূলনেত্রী। এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কার্যক্রম চলে মূলত বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এমনকি ৪-আসনের বর্তমান এমপি ফজলুল হক নওয়ার নিজেও কিছুদিন পূর্বে এই সংগঠনকে কিছু সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণে সহায়তা করেছেন।


গোডাউনের পেছনের দক্ষিণ প্রান্তে ভাড়াটে বাড়ি। পাশাপাশি আট-দশটা ছোট ছোট টিন-ছনের ঘর।  সেখানকার কোণার ঘরটা চাঁদ দাসের। ইতিমধ্যে চাঁদ দাসের ঘরের পেছনের বেঁড়া পুড়তে শুরু করেছে৷ কয়েকজন যুবকের সহযোগিতায় চাঁদ দাসের ঘর থেকে বড় ট্রাংক, আলমিরা বের করে আনতে শুরু করেছে চৈত্র এবং 'জাগরণের' স্বেচ্ছাসেবীরা।


ওদের উদ্যোগ দেখে চাঁদ দাস ও তার বউ মাথায় হাত রেখে হা-হুতাশ করা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ভাবলেন-ঘর না বাঁচুক, ঘরের জিনিসপত্রগুলো বাঁচলেও তো_'অমাবস্যার পূর্ণ চাঁদ!' এরই মধ্যে কলস, বালতি আরো বড় বড় পাত্র সমেত পানি নিয়ে এসেছে দাস পাড়ার মহিলা, পুরুষ ও 'জাগরণ' সদস্য মহি, তনি, শিউলি ও কণারা। এতে ঘরবাড়িতে আ'গুন নেভানোর কাজ কিছুটা সহজতর হলো।


_____________________


একত্রে পুড়তে থাকা গোডাউনগুলোর সামনে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে দূর্জয়। ওর থেকে হাত পাঁচেক দূরত্বের ব্যবধানে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে চিত্রণ। দুজনেই তাকিয়ে দেখছে আ'গুনের লেলিহান শিখার দিকে। পুরো শহরে এই বিশাল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জনে জনে লোক দেখতে আসছে ঘটনাস্থলে। তবে সাহায্য করতে নয়, আ'গুন নেভানোর প্রক্রিয়া আর মানুষের আহাজারি দেখছে তারা। কাছা দিয়ে লুঙ্গি কোমর অবধি তুলে হাঁটু সমান পেড়ি কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সেরনিয়াবাত। চিত্রণের জিন্সও হাঁটু অবধি গোটানো। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসেছে প্রায় ষোল-সতেরটা। গোডাউনের সাথে ঘেঁষা নদীপথেও স্পিডবোট নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসেছে। গোডাউনের সামনের অংশ সম্পূর্ণ অগ্নিবীণায় গ্রাস করে নিয়েছে। তাই নদীপথে এমন ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ফায়ার সার্ভিস টিমের কাজ করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। বিদ্যুৎ থাকলে অন্তত বিদ্যুৎ লাইনের সাথে মোটর পাইপ সংযুক্ত করে, নদী থেকে পানি পাইপের সাহায্যে নিয়ে আ'গুন নেভানোর ব্যবস্থা করা যেতো। দুর্ভাগ্যবশত মোটরেও কিছু টেকনিক্যাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে। এদিকে আ'গুনের ভয়াবহ অবস্থা। গোডাউন এবং তার আশেপাশের সবকিছু যেন নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে!


______হঠাৎ! মিল সেক্রেটারি রমিজের চিৎকার শোনা গেল। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল দূর্জয় ও চিত্রণ। দেখা গেল, নিজ গোডাউনগুলোর এমন বেহাল দশায় নদীর পাড়ে বসে, মাথায় হাত রেখে আহাজারি করছেন জমাদ্দার মহাশয়। তার হাত কিঞ্চিৎ দগ্ধ। পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি রমিজও চিৎকার করে আহাজারি করছেন। স্পিডবোট, ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ট্রলারে আসা দশ-বারো জন সাংবাদিকদের ক্যামেরা তাদের দিকে ফোকাস করে আছে। আশেপাশে সাধারণ জনতা অতি উৎসুক দৃষ্টিতে লক্ষ করছে।


'বাবারা, তোমরা আর কিছু না হোক গোডাউনের ভেতরের কোটি টাকার পাটগুলো একটু বাঁচিয়ে দাও। ওগুলো আমার সোনা, স্বপ্ন আমার৷ ওগুলোর কিছু হইলে, আমি আর জিন্দা থাকবো না। এইটুকুন একটু করো তোমরা আমার জন্য।'


দূর্জয় আর চিত্রণকে ধরে বলেন জমাদ্দার। তার এমন করুণ দশায় হতভম্ব হলো ওরা। কী করবে এখন! বুঝতে পারে না কী করবে। ফায়ার সার্ভিসের হাতে গোণা কয়েকজন গোডাউনের ভেতরে প্রবেশ করেছে। বাকিরা চারিদিক থেকে পাইপের দ্বারা পানি দিচ্ছে। কেউ কেউ ছুটে গিয়ে দরকারি সরঞ্জাম নিয়ে আসছে। অথচ কেউ সোনালী আঁশকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করছে না।


অচকিতে সেরনিয়াবাত বলে ওঠে_'আমি গোডাউনের ভেতরে যাবো। আর কেউ যাবে আমার সাথে?'


দূর্জয়ের কথায় ছাত্রলীগ সদস্যরা নড়েচড়ে ওঠে। 

'কী বলেন লিডার?! না, না! আপনি ভেতরে যেয়েন না। আ'গুন কিন্তু ভয়ংকর। গোডাউনে পা রাখারও জায়গা নেই।'


ছাত্রলীগের সদস্যদের সমস্বরে বলা কথা গায়ে নেয় না সেরনিয়াবাত। নিজ সিদ্ধান্তে দৃঢ় অটুট সে। পুনরায় বলে,

'আর কেউ যাবে আমার সাথে?'


হঠাৎ চিত্রণ বললো-'আমি যাবো।'

চিত্রণের কথায় কপাল কুঁচকায় দূর্জয়৷ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয় ওকে। পরমুহূর্তেই পেড়ি কাদা পেরিয়ে নদী ঘেঁষা পেছন পথ থেকে গোডাউনের ভেতরে প্রবেশ করে ও। সাথে চিত্রণ।


___________________


জলফড়িং (পর্ব-০৩) - রিধিমা জান্নাত রূপা
গোডাউনের ভেতরে কয়েকজন শ্রমিক ছিল আগে থেকেই। তাদের সহযোগিতায় দূর্জয় ও চিত্রণ এখনো অক্ষত ঘরগুলো থেকে পাট ছুড়ে খোলা বড় জানালা দিয়ে নদীর পাড়ে ফেলতে লাগলো। 


পাট ফেলতে ফেলতে চিত্রণ অজান্তে প্রায় জোরেসোরেই বলে-'যা আছে দূর থেকে, সেটা না যাবে ছোঁয়া, আর না যাবে তাকে পাওয়া।'

'ঠিক এই আ'গুনের শিখাগুলোর মতো।'


ওর কথা শুনে দূর্জয় কর্কশ স্বরে ওকে উদ্দেশ্য করে বলে বসে,'তুই এ জন্মে সুধরাবি না! যেই ছ্যাঁকাখোর, সেরকমই থেকে যাবি। শালা!'



এখন পড়ছেন রাজনৈতিক ছোট গল্প

পর্ব সংখ্যা ০৯

ওর কথা শুনে দূর্জয় কর্কশ স্বরে ওকে উদ্দেশ্য করে বলে বসে,'তুই এ জন্মে সুধরাবি না! যেই ছ্যাঁকাখোর, সেরকমই থেকে যাবি। শালা!'


চিত্রণ হতভম্ব হলো। এমন কথা যে ও এর আগে কখনো শোনেনি এমনটা নয়। তবে বহুবছর বাদে এধরনের অপ্রত্যাশিত কথা যেন হৃদয়ে ঝড় বইয়ে দিলো ওর। মনের গহীন আপ্লূত হলো অজানা আনন্দে৷ যদিও সেটা ক্ষণিকের জন্য প্রতিক্রিয়া। পরপরই দূর্জয়ের অতীব গম্ভীর মুখশ্রী দেখে নিজেকে সহজ স্বাভাবিক, ধাতস্থ করলো চিত্রণ৷ পুনরায় অতি দ্রুততার সহিত অক্ষত পাটের গাঁটগুলো জানালার বাইরে নদীর পাড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো ওরা। ওদেরকে সাহায্য করছে মিল শ্রমিকরা।


___________________


দাসপাড়ার সরু গলির বাইরে এসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো চৈত্র ও জাগরণ টিম। অন্ততপক্ষে ভেতরবাড়ির ঘরগুলো থেকে জিনিসপত্র বের করে আনা গেছে। বেশিরভাগ খুবই দরকারি জিনিসপত্র। যেগুলো না বের করলেই নয়! যেমন-আলমিরা, ট্রাংক, বাক্স, টেবিল, টেলিভিশন ইত্যাদি। ঘরোয়া সাংসারিক আরও নানান জিনিস। তবে সব বের করে আনা সম্ভব হয়নি। টিন, ছনের ঘর হওয়ায় আ'গুন দ্রুত সবকিছুকে গ্রাস করে নিয়েছে নিজের ভেতরে। দাসপাড়ার ছয়-সাতটা ঘরবাড়ি পু'ড়ে ছাই হয়ে গেছে। আ'গুন তার মাঝে আরও বসতবাড়িকে টেনে নেওয়ার প্রয়াসে আছে। তবে আশা করা যায় আর কিছু সময়ের ব্যবধানেই আ'গুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। শোনা গেছে গোডাউনের ভেতরকার পরিস্থিতিও নাকি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বর্তমানে।


________________


____অচকিতে! নদীর পাড়প্রান্ত, অর্থাৎ গোডাউনের পেছনে মানুষজনের জটলা থেকে গন্ডগোল, চিৎকারের শব্দ কানে আসলো চৈত্রদের। দাস পাড়ার বাসিন্দাদের সাথে তাদের ঘরবাড়ি, বসত বিষয়ক টুকটাক কথা বলছিল চৈত্ররা। পাশাপাশি এর-ওর থেকে ফায়ার সার্ভিস টিমের বর্তমান কর্মকান্ড সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছিল। নদীর পাড়ে এমন অদ্ভুত জটলা পাকাতে দেখে তড়িঘড়ি করে সেদিকটাই এগিয়ে গেল চৈত্ররা৷ 


কোনোমতে ভীড় ঠেলে মূল আকর্ষণে যেতেই চমকে উঠলো চৈত্র। চিত্রণের হাত চেপে ধরে বসে আছে দূর্জয়। ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। 


হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল চৈত্র৷ চিত্রণের পাশে উবু হয়ে বসে পড়ে ওর হাত পরখ করে দেখতে লাগলো। লোকমুখে শুনে যতটুকু বোঝা গেল_ফায়ার সার্ভিস টিমের যথেষ্ট প্রচেষ্টার পরেও পুনরায় আ'গুনের তান্ডব বেড়ে গেছে৷ তাই বিপদ আসন্ন বুঝে গো'ডাউন থেকে বের হওয়ার সময় চিত্রণের হাতে বেশ ভালোভাবেই আ'গুন ছুঁয়েছে।


ঘটনার আকষ্মিকতায় চৈত্র দিশাহারা হয়ে পড়লো। ভীড় ছাড়িয়ে দৌঁড়ে মহির স্কুটারের নিকটে চলে গেল। ফিরে এলো যখন, তখন ওর হাতে ফার্স্ট এইডের বক্স। ঘাসের উপরে চিত্রণের পাশ ঘেঁষে বসে ওর হাতে মুভ লেপন করে দিতে লাগলো চৈত্র। খানিক উদ্বিগ্নতা নিয়ে দূর্জয় ওদের পাশেই বসে ছিল হাত গুটিয়ে৷ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীরাও ওদের আশেপাশেই দাঁড়িয়ে আছে।


চিত্রণের হাতে মুভ লাগানো হয়ে গেলে মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো দূর্জয়। ও সোজা পথে হাঁটা ধরতেই ওর পিছু পিছু হালকা দৌড় দিলো চৈত্র। স্বভাববিরুদ্ধ দূর্জয়ের ডান হাত চেপে ধরতেই স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে পড়লো দূর্জয়। তবে ঘাড় ঘুরিয়েও দেখলো না কে তার হাত চেপে ধরেছে। নিরবে অসহ্য যন্ত্রণায় ঠোঁট কিঞ্চিৎ চেপে, ক্ষণিকখনের জন্য চোখ বন্ধ করলো সেরনিয়াবাত। 


'কোথায় যাচ্ছেন আপনি?'

'তোমাকে বলবো কেন মেয়ে?'

'জিজ্ঞাসা করেছি তাই এখন আপনি আমাকে বলবেন৷ বলুন কোথায় যাচ্ছেন?'

'জাহান্নামে যাচ্ছি। যাবে?'

'হ্যাঁ চলুন, যাব আপনার সাথে।'


একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো চৈত্র। অদূরে চিত্রণ পো'ড়া, হ'ত হাত নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। এদিকে চৈত্রদের ঘিরে দাঁড়ানো দূর্জয়ের কর্মী, সহযোগীদের দেখে স্তম্ভিত হলো চৈত্র। সবাই ওদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তাদের নজর চৈত্রের জাপ্টে ধরা দূর্জয়ের হাতের দিকে। তবে আপাতত তাদের এসব রিয়াকশনে কিছু যায় আসে না চৈত্রের। একটা ভয়ানক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো সে। যেটা এখন না করলেই নয়! দূর্জয়ের হাত টেনে ওকে নিরবচ্ছিন্ন একটা বেঞ্চির ওপরে নিয়ে বসালো চৈত্র। নিজে অনেকটা দূরত্ব রেখে বসলো। সেরনিয়াবাতের বিস্মিত চোখদুটো চৈত্রের এমন অদ্ভুত কার্যকলাপ দেখে চলেছে অনবরত। যদিও সে হয়তো অল্পস্বল্প বুঝতে পারছে, চিত্রণের বোন, এই মেয়েটি তাকে জনসম্মুখ থেকে কেন নিয়ে এসেছে এখানে!


'কী হচ্ছে এসব?! বে'য়াদবি করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো কেন? নেহাত জণগণের ভীড় ছিল বলে তোমাকে তেমন কিছু বলিনি ওখানে। এবার বলো, আমার হাত ধরার দুঃসাহস কে দিয়েছে তোমাকে? তোমার ঐ বেয়াদব ভাই?!'


দূর্জয়ের কথায় তিতকুটে ভাব নিলো চৈত্র। মুখে হালকা ভদ্রতার হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,

'যাকে বেয়াদব বললেন, তার হাত ধরেই তো বসে ছিলেন এতক্ষণ। তার পো'ড়া হাত দেখেই তো উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন। নিজের হাত যে কতখানিক পু'ড়ে গেছে সেদিকেও কোনো খেয়াল নেই।'


নড়েচড়ে বসে সেরনিয়াবাত।

মেধাবী ছাত্র হবার বৈজ্ঞানিক কৌশল | অধ্যায়-০১ঃ প্রতিভাবানদের ছেলেবেলা
সে কী কিছুক্ষণের জন্য চিত্রণের প্রতি বড্ড সহজ, নরম হয়েছিল। নাকি এটা শুধুমাত্র একজন পলিটিক্যাল লিডার হিসেবে কর্তব্য, সহানুভূতির ঝলক মাত্র? নিজেকে নিজে ধাতালো সে। বলিষ্ঠ বাহু ঝাকিয়ে উঠতে উদ্যোত হলো। কিন্তু চৈত্রের জন্য সম্ভব হলো না। পুনরায় ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলো।

'কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ বসুন। মুভ লাগানো হয়ে গেলেই যেতে পারবেন।'


দূর্জয়ের কনুই-তে মুভ লাগাতে লাগাতে আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো চৈত্র। বেশ  কয়েকজন ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। 

'আপনারা এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন বুঝলাম না! সার্কাস চলছে এখানে?!'


চৈত্রের কড়া চাহনি ও কথাবার্তায় এবং দূর্জয়ের কঠোর ইশারা পেয়ে সবাই একে একে কেটে পড়লো এ স্থান ছেড়ে। মুভ লাগানো হতেই চটজলদি উঠে দাঁড়ালো সেরনিয়াবাত। যাওয়ার পূর্বে একবার পিছু ঘুরে দাঁড়ালো। বলিষ্ঠ বাহু একে অপরের সাথে জুড়িয়ে চৈত্রের চোখে স্থির চোখ রেখে বললো,

'কী নাম যেন তোমার? রজনী..?

'শোনো, যেকোনো বিপদে পড়লে আমার কাছে নির্দ্বিধায় হেল্প চাইবে। দূর্জয় সেরনিয়াবাত কখনো কারো কাছে ঋণী থাকে না। এটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তোমার উপকারের প্রতিদান খুব দ্রুত পেয়ে যাবে রজনী।'

'আমার ফোন নাম্বার লেখা আছে এখানে। দরকার হলে কল করো।'


চৈত্রের হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল সেরনিয়াবাত।

'রজনী! এই নামে তো কখনো কেউ ডাকে না আমাকে৷ যদিও ভাইয়া ডাকে রজ্জ বলে। রজনী..'


দূর্জয়ের যাওয়ার পানে বিস্ময়াবদ্ধ দৃষ্টি ফেলে কথাটুকু বিরবির করে আওড়ালো চৈত্র। পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা বিদ্যমান হলো ওর। মহি দূরে দাঁড়িয়ে এসব ঘটনা দেখে দৌড়ে এগিয়ে এলো। ওদিকে লোকজনের শোরগোলে বোঝা যাচ্ছে-অগ্নিকান্ডের ভয়াবহ পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মানুষের হালকা উল্লাসধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তবুও চৈত্রের ধ্যান ভাঙছে না!

'চৈত্র আপু? আপু?'

'হা, হু!'

চৈত্রের কাঁধ ঝাকিয়ে মহি ডাকতেই ধ্যান ভাঙলো ওর। ভ্রু কুঁচকে মহির দিকে তাকালো৷ মহির চোখে মুখে কৌতূহল, বিস্ময়! যেন কোনো রহস্যের গন্ধ টের পেয়েছে ও। চৈত্র বিরক্তিকর কন্ঠে মহির উদ্দেশ্যে বললো,

'কী হয়েছে মহি? এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন!'


'আমি যা ভাবছি আপনি যদি সেই খাদে পা দিয়ে থাকেন, তাহলে মহা সর্বনাশ আপু! দূর্জয় সেরনিয়াবাত, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি। ভবিষ্যতে হয়তো বড়সড় রাজনৈতিক পদাবিষ্ট হবে। বাতাসের সুরে সুরে যতদূর শুনেছি উনি এবারের সংসদ নির্বাচনে ৪-আসনে ফজলুল হক নওয়ারের বিপরীতে এমপি পদপ্রার্থী হবেন সম্ভবত। ফজলুল হক সাহেব তো আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী চৈত্র আপু!'


মহির কথায় স্তব্ধ হলো চৈত্র। হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গেছে ওর৷ তবুও মুখের তিক্ত ভাব গেলো না ওর। বরং সেটার মাত্রা আরও বাড়িয়ে বলে-

'উল্টোপাল্টা বকছো কেন মহি? বেশ ধকল গিয়েছে। এখন আর তেমন কোনো কাজ নেই আমাদের এখানে। চলো টংয়ের দোকানে বসে চা গিলে মস্তিষ্ক সচল করবে।'


চৈত্র উল্টোপথে রাস্তার পাশের দোকানটার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। মহি বিজ্ঞ ভঙ্গিতে দু'বার মাথা নাড়িয়ে দ্রুততার সহিত হেঁটে চৈত্রের পিছু নিলো।


____________________


'তোশা, তোশা? কোথায় তুমি বউজান?'


বেলকনিতে কাপড়চোপড় নেড়ে দিচ্ছিলো তোশা। তুলনা তার দাদীর ঘরে। বেশিরভাগ সময় ও দাদীর ঘরেই থাকে।

মাসুদের চেঁচানো কন্ঠস্বরে এহেন কথা শুনে হাত থমকে যায় তোশার। কিছু সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বেলকনি ছেড়ে দ্রুত রুমে প্রবেশ করে ও।

'কোথায় তুমি বউজা..'

রুমে প্রবেশ করে পুরো কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই তোশা দৌড়ে এসে মাসুদের মুখ চেপে ধরে। মাসুদ ওর দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো।

'পুরো বাড়িময় এরকম নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে চেঁচিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? কাকিমণি আর মৌরিসহ বাড়িভর্তি আরো কিছু মানুষজন রয়েছে। কেউ শুনে ফেললে!'

'নির্লজ্জ কথা কোথায় বললাম! আমি তো জাস্ট আমার বউকে ডাকছি।'

'আমার একটা নাম আছে। তোশা। তোশা সেরনিয়াবাত। সেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন, এমনকি দাদিমার সামনেও বউজান বলে সম্বোধন করাটা একপ্রকার নির্লজ্জতা৷ এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছেন অলরেডি! এবার একটু নিজেকে সংযত করুন।'


তোশার রুক্ষ কথার আঘাতে সামান্য মুচকি হেসে ওঠে মাসুদ। বিছানায় দুপাশে দু'হাতে ভর করে রেখে সাহেবি কায়দায় বসে ও। তোশা এখনো একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। আচমকা ওকে টান মেরে নিজের কোলের ওপর ফেলে দেয় মাসুদ।


বয়স পয়ত্রিশের কোঠায় সবে পা রেখেছে। ঝাঁকড়া চুল, হালকা চাপদাড়ির দু-একটা সাদা বর্ণ ধারণ করলেও চেহারায় বয়সের ছাপ ছিটেফোঁটাও নেই মাসুদের। বরং ওকে দেখলে বোঝাই যায় না, ইতিমধ্যে এক বাচ্চার বাপও হয়ে গেছে! সেরনিয়াবাত বংশের পুরুষদের এই এক সুবিধা। তাদের চেহারা, পার্সোনালিটি কখনো বয়সের সাথে খাপ খায় না। যেন যেকোনো বয়সেও জোয়ান, তাগড়াই পুরুষ তারা। 


মাসুদের ফর্মাল স্টাইলে পড়া হোয়াইট শার্টের কলার হালকা আবেশে ধরে রেখেছে তোশা৷ চোখ, মাথা বরাবরের ন্যায় ওর ফ্লোরের দিকে আবিষ্ট। যেন পুরো ফ্লোরের অদৃশ্য জীবাণুগুলোও সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে!


'বউজান?'

'জ..জ্বী?'

'মনে আছে পরশু কী?'

'উহম..?'

ভাবনায় পড়লো তোশা। দুমিনিট মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই মনে পরে গেল পরশু দিনটার কথা৷ যদিও এই দিনটা নিয়ে তার বিশেষ প্রফুল্লতা নেই৷ তাই সহসা ভুলে যাওয়ার জন্যও আফসোস করলো না সে। মাসুদের সামনে কোনো প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করলো না।

'পরশু আমাদের এ্যানিভার্সারি৷ তুমি এই দিনটার জন্য খুশি নও বউজান?'


'জীবনের সবথেকে বড়ো পাপকাজ তো আমি এইদিনে করেছিলাম৷ এই দিনে খুশি নয়, বরং আফসোস, আক্ষেপ হয় আমার৷ খুব করে নিজেকে পাপী মনে হয়।'


মাসুদের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নিজ মনে বিরবির করতে থাকে তোশা। মাসুদের হাতের দ্বারা তৈরি শক্তপোক্ত বাঁধন হতে নিজেকে মুক্ত করার অসম্ভব চেষ্টা চালালো তোশা। কিন্তু দুর্ভাগ্য! এক বাচ্চার মা হয়েও তার ছোট কবুতরের ছানার মতো শরীর, শক্তি৷ যে শরীর মাসুদের পুরুষালি তেজ, শক্তির কাছে অবশ্যই হার মানে প্রতি মূহুর্তে। সেখানে বর্তমানে মেজাজ চড়াও করে মাসুদের হাতের বাঁধন মারাত্মক কঠোর।


এখন পড়ছেন বাংলা রাজনৈতিক গল্প

পর্ব সংখ্যা-১০

মাসুদের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে নিজ মনে বিরবির করতে থাকে তোশা। মাসুদের হাতের দ্বারা তৈরি শক্তপোক্ত বাঁধন হতে নিজেকে মুক্ত করার অসম্ভব চেষ্টা চালালো তোশা। কিন্তু দুর্ভাগ্য! এক বাচ্চার মা হয়েও তার ছোট কবুতরের ছানার মতো শরীর, শক্তি৷ যে শরীর মাসুদের পুরুষালি তেজ, শক্তির কাছে অবশ্যই হার মানে প্রতি মূহুর্তে। সেখানে বর্তমানে মেজাজ চড়াও করে মাসুদের হাতের বাঁধন মারাত্মক কঠোর।


'মনে মনে বিরবির না করে যত কথা আছে মুখে বলে দাও। তবুও প্রেয়সীর এই নিরবতা নামক ভয়ঙ্কর আ'ঘাত, য'ন্ত্রণা থেকে অন্তত মুক্তি পেয়ে যেতাম!'


হাহ! একবুক দীর্ঘশ্বাসের সাথে বোধহয় আফসোস   ব্যক্ত হলো মাসুদের কথায়। তবে এতে তোশা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। শুধু কবুতর ছানার ন্যায় হিংস্র নেকড়ের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় প্রবল রত রইলো। মাসুদও নাছোড়বান্দা। তোশাকে নিজের হাতের বাঁধন হতে মুক্ত করলো না। ওর খোলা, এলোমেলো চুলের মধ্যে নিজের মুখ ডুবিয়ে বসে রইলো মূর্তমান।

জ্বীনের খাটিয়া ( পর্ব-০২) - রিয়াজ রাজ
এমন ভাবে, যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে ধূর্ত, নিরীক্ষমান শিকারীর বহু সাধ্য-সাধনার সোনার টিয়াপাখি! ততক্ষণ একই ভঙ্গিমায় রইলো, যখন না মৌরি এসে দরজার সামনে স্বামী-স্ত্রীর এমন ব্যক্তিগত দৃশ্য দেখে থমকিত, স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। 

তোশার নজর আধখোলা দরজার দিকে পড়তেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মোচড়ানো, ছটফটিয়ে উঠলো ও। মৌরির মাথা ফ্লোরের দিকে। দৃষ্টি নত। এমন পরিস্থিতি। অথচ সবেতেই যেন মাসুদের ডোন্ট কেয়ার ভাব! মিনিট দুয়েক এমতাবস্থায় অতিবাহিত করে মৌরিকে রুমের ভেতরে ডাক দিলো মাসুদ। মৌরি মৃদু লজ্জিত ভাবের সহিত রুমে প্রবেশ করলো।


সাধারণত বাড়ির নাম দেওয়া যায়। বাড়ির মেইন গেটের নেমপ্লেটে উজ্জ্বল করে থাকে মালিকের মনোভাব অনুযায়ী বাড়িগুলোর একেকটা নাম৷  বিভিন্ন বাড়ির নাম থাকে→সরদার বাড়ি। মোড়ল বাড়ি। তালুকদার বাড়ি। এই মহল, সেই মহল। ইত্যাদি ইত্যাদি। সেরনিয়াবাতদের বাড়িরও একটা নাম আছে। ❝রাণী মহল❞। কিন্তু বাড়ির আট-দশটা ঘরের মধ্যে একটা ঘরের আলাদা করে যে নাম থাকতে পারে, এই ব্যাপারটা অদ্ভুত এবং রোমাঞ্চকর! মাসুদের রুমটির একটা ব্যক্তিগত ডাকনাম আছে। আজ থেকে প্রায় ছয়-সাত বছর আগে তার ব্যাচেলর জীবনের সমাপ্তিতে সে এই রুমের নাম দিয়েছিল ❝তোশাজান❞। যা এতো বছরেও পরিবর্তন হয়নি। এবং মাসুদের ভাষ্যমতে, ভবিষ্যতেও এর পরিবর্তন হবে না।


এই কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর রুমটার একটা বিশেষ নাম আছে। এই ব্যাপারটা সবার ভালো লাগলেও, সবার মুগ্ধতার কারণ হলেও গুটিকয়েক মানুষের পছন্দের নয়। যারা হয়তোবা গোপনে-অগোচরে„ আড়ালে-আবডালে মাসুদের এহেন কর্মকান্ডকে "অতিরিক্ত বউ-পাগলামি কিংবা আদিখ্যেতা" বলে দাবি করে বেড়ায়। যদিও এতে মাসুদের বিশেষ কিছু যায় আসে না!


———

'ভাবীরে নিচে ডাকছে কাকীমা।'


মৌরির কথা শুনে চটজলদি নিচতলায় চলে যায় তোশা। এদিকে মাসুদ দু'হাত বিছানায় ঠেকিয়ে ঠায় বসে ছিল। উঠে দাঁড়াতেই মৌরি হাত ধরে ফেলে মাসুদের। মাসুদ চোখ-মুখ কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মৌরির দিকে।


"মাসুদ আপনে আমারে এড়ায়ে যান ক্যান সবসময়?"


"আমি তোর বড়ভাই সমতুল্য মৌরি। আমার থেকে কম করে হলেও আট-দশ বছরের ছোট তুই! সেক্ষেত্রে এভাবে নাম উল্লেখ করে ডাকা—একপ্রকার অসভ্যতা।"


মৌরির হাতের বাঁধন হতে নিজের হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা ধরলো মাসুদ।


'আমি আপনারে ভালোবাসি মাসুদ। আর কতবার বলবো আপনারে?'


আচনক মৌরির এমন সোজা কথায় নিরেট দাঁড়িয়ে যায় মাসুদ। ভ্রু কুঁচকে, কপালের দুপাশের শিরা ফুলিয়ে বলে,

"একজন বিবাহত, এক বাচ্চার বাপকে ভালোবাসার কথা বলতে লজ্জা করছে না তোর! এখন কী পরকীয়া করবো তোর সাথে?! "

মাসুদের কাঠখোট্টা কথায় শরমে মাথা নত করে ফেলে মৌরি৷ নেহাত অসহায় হওয়ার ভান ধরলো ও। 


____________________


'ও মাধবীলতা। মারে..। তোর কথা যে কত মনে পড়ে|'


নিজের ঘরে বসে বিলাপ করছিলেন চৈত্রের দাদী বিউটি বেগম। তার পাশে কাঁধে হাত রেখে বসে ছিলেন অনিমা। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যেতেই বুক কেঁপে উঠলো তার। দরজা ঘেঁষে স্থির দাঁড়িয়ে আছে চৈত্র। কাঁধে টোট ব্যাগ। সবেমাত্র অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থল থেকে ফিরেছে সে৷৷ বাইরে থেকে ফিরে মাত্রই বসার ঘরে আসতেই দাদীর ঘর হতে কান্নার সুরের শব্দ পেয়েই এখানে আসা তার। চোখ-মুখ থেকে কৌতূহল, বিস্ময় এখনো সরেনি ওর। 


'আম্মা। চুপ করেন। চৈত্র দাঁড়িয়ে আছে দুয়ারে।'


বউমার কথা শুনে চমকে থামলের বিউটি বেগম। এবার সরাসরি ঘরে প্রবেশ করলো চৈত্র।


'মা। দাদী কান্নাকাটি করছে কেন? কী হয়েছে?'

'তেমন কিছু না মা। তোর দাদার কথা মনে পড়ছিল অনেক। তাই। আচ্ছা শোন, আগামীকাল বাড়ি থেকে বের হোস্ না। কাজ আছে অনেক।'


অনিমা কথা ঘুরিয়ে নিলেন। বিউটি বেগমও চুপচাপ হয়ে গেছেন। 

'কী কাজ মা?'

'আগামীকাল বাড়িতে কিছু অসহায়, এতিম বাচ্চাদেরকে খাওয়ানোর তোড়জোড় আছে। হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিবি। চন্দ্রাও আসবে৷'


'কিন্তু আগামীকালই কেন মা? অন্যদিন কেন নয়? প্রতিবছর এই দিনটাতেই কেন এমন তোড়জোড় হয় আমাদের বাড়িতে? কারো মৃত্যুবার্ষিকী নয় আমার জানামতে। দাদার মৃত্যুবার্ষিকী তো জুলাইয়ের শেষে।'


চৈত্রের কথায় চকিত হয়ে পড়লেন অনিমা। বিছানা ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। চৈত্রের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর গালে হাত রাখলেন।

'প্রতিবছর এই দিনে এরকম তোড়জোড় করে মিলাদ, এতিম, অসহায়দের খাওয়ার কারণ জানতে চাস? কই এতোবছরে তো কখনো জিজ্ঞাসা করিসনি একথা। তবে শুনে রাখ মা, মনে করবি তোর মায়ের বড় বোনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এমনটা করি।'

'কিন্তু মা..'

'কোনো কিন্তু না। তুই তোর মাকে এতোবছরে এই প্রথম কোনো কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিস। কৈফিয়ত চেয়েছিস। আমি জবাব দিয়েছি৷ আমি আশা করবো আমার সন্তান আর দ্বিতীয়বার কখনো আমাকে এই প্রশ্নটা করবে না।'


ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন অনিমা। চৈত্র ঠায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কী তার মায়ের কাছে প্রতিবছর করা এহেন কাজের উত্তর চেয়ে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! নিজেকে বড্ড অপরাধী অপরাধী মনে হলো ওর। নিজমনে বললো—

'কিন্তু মায়ের তো কোনো বড় বোনই নেই! তাহলে?'


___________________


আজ গোটা দু'দিন বাদে রাণী বেগমের ঘরে এসেছে দূর্জয়। সচারাচর প্রতিদিনে প্রায় চার-পাঁচবার তার দাদীজানের ঘরে আসা হয়। তবে গত দু'দিন কাজের চাপ একটু বেশিই ছিল সেরনিয়াবাতের৷ রাতে সে ঘুমাতেও পারেনি ঠিকঠাকমতো। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের আর্থিক সহায়তার জন্য বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান, কার্যকরী কার্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে তার। অবশ্য কাজ হয়েছে যথাযথ। তাই আজ দুপুর তিনটার পরেই পরম নিশ্চিন্তে একটা দারুণ ঘুম দিয়ে সন্ধ্যায় দাদীজানের ঘরে সেরনিয়াবাতের প্রবেশ।


রাণী বেগম দূর্জয়কে দেখে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে উঠে বসলেন। বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে তার। এখনো শক্ত সামর্থ্য থাকলেও বাতের ব্যাথার জন্য বেশিরভাগ সময়ে নিজের ঘরেই শুয়ে থাকেন তিনি। যদিও তাকে কখনো একা থাকতে হয় না৷ সবসময় তোশা, রোজানা বেগম নাহয় অন্য কেউ থাকবেই তার ঘরে। সেরনিয়াবাতদের অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকার কারণে বছরের প্রায় বারোমাসই রাণী মহল মেহমানে পরিপূর্ণ থাকে। এই যেমন শীতের মৌসুমে পূর্বাঞ্চল থেকে বেড়াতে এসেছে দূর্জয়ের বিধবা কাকিমণি পেয়ারা বেগম ও তার মেয়ে মৌরি রহমান। মৌরি এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।


'ও ছোট সেরনিয়াবাত। আইজকা তবে মনে পড়লো তোমার জানের কথা!'


দূর্জয় ঘরের এককোণে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। কাকিমণি ঘরে থাকায় মোটামুটি চুপচাপ সে। হয়তো দাদীজানের সাথে নিজস্ব কিছু কথা বলবে৷


বিচক্ষণ রাণী বেগম ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। তাই চোখের ইশারায় পেয়ারাকে বাইরে যেতে বললেন। 

পেয়ারা বেগম বের হতেই দাদীজানের পাশ ঘেঁষে বসলো দূর্জয়। তার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।

'কেমন আছো জান? তোমার শরীরের অবস্থা অবস্থা কেমন?'

'তোমারে কতদিন দেখি না। ভালো থাকি ক্যামনে বলো!'

'কী বলো তুমি? মাত্র তো দু'দিন হলো!'


হাসলো দূর্জয়। সে জানে তার দাদীজান তাকে কতোটা চোখে হারায়! একদিন না দেখলেই যেন ভাবে সহস্র বছর না দেখে আছে!

'তোমারে হাসলে ঐ ফোকলা দাঁতে যে কী সুন্দার লাগে সেরনিয়াবাত! মাইয়ারা তো মনে হয় ঘুইরা পড়ে।'


'এসব কথা বাদ দাও তো জান। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। তোমার কোলে একটু মাথা রাখি?'


গোটা দুনিয়ার নিকটে গম্ভীর, কাটখোট্টা নেতা দূর্জয় সেরনিয়াবাত একমাত্র তার দাদীজানের সান্নিধ্যে এলেই যেন শৈশবে ফিরে যায়! নিজের বয়স, অবস্থান সবকিছু ভুলে দাদীজানের সেই ছোট্ট নাতিতে পরিণত হয়!

দূর্জয়ের এমন আবদার বাচ্চামো মনে হলেও  ঘুনাক্ষরেও কখনো এটার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন না রাণী বেগম। বরং বরাবরের মতোই আজও তার সোনালী পাড়ে সাদা শাড়ি মেলে তার কোলে মাথা রাখার স্থান করে দিলেন রাণী বেগম। দূর্জয়ের মাথার সদ্য যেন জেল লাগানো চুল গুলোতে পরম মমতার সহিত হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তিনি। 

'একটা কথা কইবো ছোট?'

'জ্বী, বলো জান।'

অধ্যায়-০২ঃ মেধা : জন্মগত, না অর্জিত?
'কইতাছি, এবার ব্যবসায় যোগ দাও। আর বিয়াটা কইরাই নাও এই বছরেই।'


দাদীজানের কথা শুনে সেরনিয়াবাত চমকালো। ভ্রু কুঁচকে ফেললো৷ তবে কোল ছেড়ে উঠলো না। 


'এতোদিনে তাহলে তুমিও আমার বিপক্ষে চলে গেলে জান? রাজনৈতিক ব্যাপারে দাদা বেঁচে থাকতে তার সাপোর্ট পেয়েছিলাম৷ তার মা'রা যাওয়ার পরে পরিবারে সেভাবে বলতে গেলে তোমার সাপোর্টই বেশি পেয়েছি। সেই তুমিও..'


'আহা। আগে আমার কথাটা শোনো। এতোদিনে আমার এখন কথা বলার সময় হইছে।' 

'তুমি রাজনীতি কইরা কী করতেছো? বিয়ে-শাদি করছো? করো নাই। তোমার মায়ের শখ হয় না নাতিপুতির মুখ দেখোনের? আমি যে সত্তর বছর বাঁচছি, কী এই ঘরে পইড়া থাকোনের জন্ন? আমার কী অধিকার নাই— নাতির সন্তান দেখোনের বাসনা রাখার? আর কতোদিন কও? কম তো হইল না! একত্রিশটা বছর! কম?'

'তোমার মায়ে দিনে অন্তত একবার আমার কাছে আইসা কান্দাকাটি কইরা যায়৷ তার ছোট ছেলেটার চিন্তায়। মাসুইদ্দা তো পঁচিশ বছর বয়সেই প্রেমের বিয়া কইরা, তার এক বছরের মাথায় বাচ্চা নিয়া ছক্কা হাঁকান দিছে। তুমি কী করতেছো?'


'রাজনীতি।'

দূর্জয়ের থেকে এমন উত্তর আশা করেননি রাণী বেগম। ভেবেছিলেন, এবার হয়তো তার ছোট সেরনিয়াবাত একটু মতামত বদলাবে। তবে তাকে হতাশ করলো দূর্জয়।  

'আর কিছু করবানা?'

'রাজনীতিই করবো।'

'রাজনীতির বাইরে কিছু নাই?'

'না জান। আমার জীবনে শুধুই রাজনীতি আছে।'

'পরিবার?'

'অবশ্যই তারাও আমার জীবনের একটা বিশাল অংশ। তবে রাজনীতি আলাদা ক্ষেত্র।'

'পরিবারকে ভালোবাসো না?'

'অবশ্যই। তবে পরিবার তার জায়গায়। আর রাজনীতি তার স্থানে। দুটোকে এক করতে চাই না।'


দূর্জয়ের এমন একরোখা জবাবে খুব হতাশ হলেন রাণী বেগম। তবুও হাল ছাড়লেন না।

'আচ্ছা বাদ দাও। তোমার ব্যবসা করতে হইবো না। রাজনীতিই করো। কিন্তু বিয়া-থাও যদি..'

'বিয়ে করে তখন আমি বউ সামলাবো নাকি রাজনীতি করবো?!'

'তুমি খালি বিয়া করো। বউ সামলাইতে হইবো ক্যা?'

'এখনকার মেয়েরা স্বভাববশত যে ন্যাকা। মনে করো, একটা ইম্পর্ট্যান্ট পলিটিক্যাল মিটিংয়ে আছি। তখন আমার বিয়ে করা বউ হুট করে ফোন দিয়ে বললো-"আমার এখন খুব কান্না পাচ্ছে। জলদি বাড়িতে ফিরে আমার কান্না থামান। নাহলে আমি বাপের বাড়িতে চলে যাব।"

তখন আমি মিটিং সামলাবো, নাকি বউ! তুমি বলে দাও। একদিকে আমার ক্যারিয়ার—রাজনীতি৷ অপরদিকে আমার পুষ্পকোমল বউ—আমার অর্ধাঙ্গিনী।'


দূর্জয় কথাটা বেরসিকতার সাথে বললেও রাণী বেগম হেসে গড়িয়ে পড়লেন। কথাটায় যেন বেশ মজা পেয়েছেন তিনি। হাসতে হাসতে তার বাতের ব্যাথাটা জেগে উঠলো৷ উহ! শব্দ করে উঠলেন তিনি৷ দূর্জয় বুঝতে পেরে তার মাকে ডেকে পাঠিয়ে দিলো রাণী বেগমের ঘরে৷ নিজে বেরিয়ে পড়লো তফসিল অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ সেখানে একটা সম্মেলন আছে। পরশু শহরের প্রেসক্লাবে শীতকালীন পিঠাপুলি উৎসবের আয়োজন উপলক্ষে স্টল বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও রয়েছে সেখানে।



প্রিয় পাঠক, সর্বশেষে একটা কথাই বলতে চাই, আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের এই আয়োজন। আপনার একটি শেয়ার আমাদেরকে গল্প পোস্ট করার স্পৃহা দ্বিগুন করে তোলে। তাই অনুরোধ রইলো একটি শেয়ার করবেন এবং “ঈগল সন্ধি ১ম খন্ড - রাজনীতি গল্পের লিংক” গল্পটি আপনাদের কেমন লেগেছে তা  নিচের কমেন্ট বক্সে একটি কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। পরের গল্পটি পড়ার জন্য আমন্ত্রন রইলো। ধন্যবাদ।{alertInfo}

জলফড়িং (পর্ব-০৩) - রিধিমা জান্নাত রূপা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

দয়া করে স্পাম করা থেকে বিরত থাকুন।