তোর সমীপে || গল্পকন্যা - পর্ব-০৫

তোর সমীপে || গল্পকন্যা - পর্ব-০৫
তোর সমীপে || গল্পকন্যা - পর্ব-০৫

তোর সমীপে (পর্ব-০৫)
গল্পকন্যা

পর্ব ০৪ পড়ুনঃ তোর সমীপে || গল্পকন্যা - পর্ব-০৫.

আসমা বেগম পুষ্পর ঘরে এসে পুষ্পকে শাসানি দিচ্ছেন, সাথে এ-ও বলে ধমকে দিচ্ছেন, এ সব কথা  উনি বলছেন কেউ যেন না জানে। পুষ্পর কষ্ট হচ্ছে, তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনে যাচ্ছে।


হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে দরজা ঠেলতে ঠেলতে ভিতরে প্রবেশ করে নিশাত।হাতে তার মোটামুটি সাইজের একটি বাক্স। আসমা বেগম চমকে যান। পুষ্প ও চমকিত; এমন আকস্মিক ঘরের ভিতরে ঢুকে যাওয়ায়।

" শাশুড়ী আবার  কিছু মনে না করে বসেন। "


নিশাতের পিছুপিছু বিথীর ও আগমনী হয়। আসমা বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নিশাত বলে, " কিছু বই উনার জন্য। একাকী থাকে...তাই আর কি! "


আসমা বেগম হাঁফ ছাড়েন, কিছু না বলে চলে যান। বুঝতে পারেন, "না কিছু শোনেনি ছেলেটা। শুনলে  বাড়াবাড়ি রকম করতো। "


বিথী বাক্সে থাকা বই গুলোর মধ্যে থেকে একটা বই তুলে নেয়। বলে, " ভাবি বই পড়া কিন্তু ভালো। যারা বেশি বেশি  বই পড়ে তারা জ্ঞানী হয়। "


নিশাত বই গুলো রেখে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়। পুষ্প নিশাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,"নাহ আমি বোকা সোকা, জ্ঞানহীন মানুষ! দেখো না কি হাল আমার! "


বিথীর মন খারাপ হয়ে যায়। আকস্মিক ঘরের দরজায় টোকা পড়ে।  দরজার কাছ থেকে কেউ বলে, "ভিতরে আসবো? "


কন্ঠটা চিনতে পুষ্পর একটুও ভুল হয়নি। বলে, " আয়...! "


বিথী ভাবে, " কে? কাকে ভাবি আয় বলছে? এ বাড়িতে তো এমন কেউ নেই , যাকে আয় বলে সম্বোধন করবে! "


তখুনি ভিতরে প্রবেশ করে  সিমসাম গরনের, গৌড় বর্ণের লম্বা একুশ বাইশ বছর বয়সী এক ছেলে। চেহেরার আদল অনেকটা পুষ্পর মতোই। কোথাও দেখেছে কি? বিথী মনে করতে পারছে না।


ছেলেটি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে সরাসরি পুষ্পর মুখোমুখি মেঝেতে বসে পরে। পুষ্পর দিকে তাকিয়ে হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, "কেমন আছিস? আমার সাথে ও অভিমান করে আছিস? আমি তো এসবের কিছুই জানি না। কোনো কিছুর আগুপিছুতেই নেই। "


থেমে ফের বলে, "তুই ছাড়া কিভাবে বাড়িতে দিন কাটাচ্ছি জানিস? আমার দমবন্ধ লাগে আপু। তোকে ছাড়া আমি ভালো নেই। আমার সাথে অভিমান করে থাকলে আমি কিন্তু কোনো এক দিকে চলে যাবো। পরে কিন্তু খুঁজে পাবি না আর। "অভিমানি কন্ঠে গড়গড় করে মনের কথা বলতে থাকে। এতোটা আবেগে আপ্লূত যে পাশে থাকা রমনীকে খেয়ালই করেনি।


বিগত এক মাস পর আদরের ছোটো ভাইকে দেখে চোখ জল ছলছল হয়ে গেছে। তারউপর এমন অভিমানী স্বরের অভিমান মাখা বাক্য বুকের ভিতর হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবুও এতোদিন পর ভাইকে দেখে, ভাইয়ের কথা শুনে পুষ্পর ঠোঁট প্রসস্থ হয়। চোখে জল অথচ ঠোঁটে হাসি, বোনের এ দৃশ্য দেখে পাবনের কান্না আসছে, বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে ।


জল ছলাৎ ছলাৎ চোখে চেয়ে ঠোঁটে স্মিথ হাসি নিয়ে ভাইয়ের মাথার ঝাঁকরা চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে বলে, "পাগল ছেলে, তোর সাথে আমার কোনো অভিমান নেই। কোথাও যাওয়া হবে না তোর। "


বিথী এতোক্ষণে বুঝতে পারল, এই ছেলেটাকে সে বিয়েতে দেখেছিলো। তার মানে ছেলেটা ভাবির ভাই। ওদের মিলন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে বিথীর মনে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করলো। ছেলেটার বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বোনের সাথে আহ্লাদিপনা বিথীকে মুগ্ধ করলো। এতো বড়ো ছেলেকে এমন বাচ্চামো করতে দেখবে ভাবা যায় না। যখন পুষ্প পাবনের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, পাবনের চোখ থেকে টুপ করে দু'ফোটা জল গড়িয়ে উড়ুতে পড়লো।


কেন যেন প্রথম দেখায় ছেলেটার বোনের প্রতি থাকা মায়া মমতা, বিথীর মন ছুঁয়ে গেলো।


বিথীর মনে হয়, "ছেলেদের মন হয় শক্ত। সকল দুঃখ কষ্টে তারা অটল থাকে। বাস্তবতা মেনে ধৈর্য্য ধারন করতে করতে এক পর্যায়ে তারা কঠিন পাথরে রুপান্তরিত হয়ে যায়। তখন তাদের ভিতরকার কষ্টের জন্য চোখে পানি আসে না। কিন্তু যে ছেলেরা কাঁদতে পারে, তাদের মনের ভিতর ও বাহির উভয় নরম হয়। তারা কোমলপ্রাণের অধিকারী হয়। খুব সহজেই তারা ঠকে যায় আর ভেঙে পরে। এরা পুরোপুরি তাদের প্রিয় মানুষগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়। নিসন্দেহে এদের ভালোবেসে আপন করে নেয়া যায়।"


 বিথীর ছেলেটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো। তাই নিজ থেকে বললো, "আমি ভাবির ননদ বিথী। আমার সাথেও একটু কথা বলেন। নিজেরা নিজেরাই শুধু কথা বলে যাচ্ছেন। আমি কি তেলাপোকা নাকি যে আমাকে দেখা যাচ্ছে না! "


 বিথীর সহজ সরল কথায়, এমন মর্মান্তিক মুহূর্তেও পাবন হেঁসে উঠতে বাধ্য হয়। তাই দেখে বিথী বোকা বনে যায়। কেউ ওকে পাত্তা না দিলে ওর কষ্ট হয়। তারউপর ওর ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে, সেখানে ছেলেটা হেসে মজা নিচ্ছে। বিথী ঠোঁট উল্টে পুষ্পর দিকে তাকায় ।


পুষ্প চোখ রাঙিয়ে পাবনের দিকে তাকায়। পাবন বলে, "আচ্ছা সরি, সরি বেয়াইন। তা আপনি যে আছেন আমি সত্যিই দেখিনি। মেকাপ করেননি তো তাই ব্রাইটনেস কমে গেছে আরকি। যান গিয়ে একটু মেকাপ করে আসেন। "


বিথী বলে, "ভাবিইইই, তোমার ভাই দেখি প্রচন্ড বিচ্ছু? "

পুষ্প মুচকি হাসে।বিথীকে বলে,"কিছু বলবে আমাকে?"


"নাহ তো, কেন?"

"আসলে কখনো আমার রুমে আসো না তো! "

"এখন থেকে আসবো, আর নিয়মিত তোমার সাথে আড্ডা দিবো। "পুষ্প খুশি হয়ে যায় এ কথা শুনে। আসুক বা না আসুক বলেছে তো,  সেটাই অনেক প্রাপ্তি।


পাবন এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। পুষ্পর মতোই পড়াশোনায় ভালো। তবে অনেক চঞ্চল সভাবের, মনের দিক থেকে একদম আবেগি, নরম মনের মানুষ। তবে ওর উপাধি দিলে এক কথায় ওকে  মহা দুষ্ট ও বলা যেতে পারে।


পাবন সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, " আপু আমার একটা কথা রাখবি? "


" কি কথা? "

" আমাকে ছুঁয়ে বল রাখবি। "


পুষ্প কিছুক্ষণ ভেবে বলে," রাখার চেষ্টা করবো, বল। তবে আসফাক উদ্দিন সম্পৃক্ত কোনো কথা যেন না হয়। "


পাবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "তুই পড়াশোনাটা ছাড়িস না। পরীক্ষাটা দে প্লিজ। এভাবে জীবন কাটানো যায় না। "


পুষ্প বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়, মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগে বলা শাশুড়ীর নিষেধাজ্ঞা, "নাহ পাবন! এটা সম্ভব না। আমার পরিস্থিতি তোর অজানা না। এখন বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করা  সম্ভব না। আমি অপয়া অলক্ষুণে মানুষ। আমার অদৃষ্টের লিখন ই এমন। "


নিশাত রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, "কেন সম্ভব না!" 


সকলেই আওয়াজের উৎস লক্ষ্য করে দরজার দিকে তাকায়। নিশাতের তখন একটা কথা বলার ছিলো, না বলেই চলে গিয়েছিলো, মনে হতেই আবার এসেছে। অসমাপ্ত কথাটি সমাপ্ত করতে দরজা নক করতে গিয়ে দেখে, দরজা খোলা। আর ভিতর থেকে পাবন ও পুষ্পর কথা ভেসে আসছে।


তিনজনই নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশাত বলে, "কেন সম্ভব নয়?অবশ্যই সম্ভব। আপনি চাইলেই সম্ভব।" রুমের একটা ভারি কাঠের চেয়ার টেনে বসে পড়ে।


পাবন পকেট থেকে ফোন বের করে পুষ্পর বন্ধুদের ফোন করে। সবাই একি সাথে একি স্ক্রিনে গ্রুপ কলে থেকে পুষ্পকে হায় হ্যালো করতে থাকে। পুষ্প ছোটো ভাইয়ের কান্ডে অবাক হলেও বন্ধুদের এক সাথে দেখে খুশি হয়।


যেখানে একটা দিন এমন যেতো না যে আজকে ওদের সাথে দেখা বা কথা হয়নি। সেখানে আজ মাস খানেক ধরে কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। পুষ্পর মনে খানিক প্রশান্তি বিরাজ করছে।


সবাই একে একে তাদের জমানো সব কথা বলে যাচ্ছে। রবিন তো ফেলফেল করে কেঁদেই ফেলেছে। বারবার ঠিকানা চাইতে থাকে। যদি ও তার পিছনে বিরাট কাহিনি আছে। সেটা পরে জানাবো আপনাদের ।


পুষ্পর বান্ধবী প্রভা বলে, "বান্ধবী আমি সব নোটস তোর বাসায় পাবনের হাতে পাঠিয়ে দিবো, পড়া গুলো তৈরি করে নিস।আর বেশি দিন হাতে নেই ।"


আকাশ বলে, "দোস্ত, কোনো থিওরি বুঝতে অসুবিধা হলে, পাবনের ফোনে কলে আসিস, বুঝিয়ে দিবো। ঝিমাইন্না মুরগি হয়ে যাইস না আবার।" পুষ্প হেঁসে ফেলে।


সবাই সবার মতো বলেই যাচ্ছে, পুষ্প জানে এরা থামার নয়। টেনে হেঁচড়ে বাড়ি থেকে ওকে বের করবেই। তাই পুষ্প সকলের কথার মাঝে সবাইকে থামিয়ে বলে, "আমি আর পড়াশোনা করবো না রে। আমার পরীক্ষা দেয়া হবে না।"


কথা শেষ হতেই সকলে মিলে পারছে না ফোনেই ওর ওপর এট্যা*ক করে ফেলে। খানিকক্ষণ সবাই মিলে পুষ্পকে উড়াধুড়া বকে। নাহিদা বলে, "যে কোনো সময় বাড়ি চলে আসবো, পেটানোর জন্য। এ্যাট এ্যানি কস্ট এক্সাম দেয়া চাই। "


ওর সাথে তাল মিলিয়ে বাকিরাও বলে, "আমরা সবাই আছি তোর পাশে...." পুষ্প কল কেটে দেয়। রুমে থাকা সকলেই অবাক। পুষ্প কি করে বোঝাবে ওর শাশুড়ী চায় না। এমনিতে ও সকলের কাছে অপয়া অলক্ষুণে। আর পাঁচজনের মতো ও সাভাবিক জীবন যাপন করছে না।


পাবন বোনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। পুষ্প কিছুতেই বোঝাতে পারছে না পাবনকে। পাবন নাছোরবান্দা।


নিশাত আকস্মিক বাজ পড়ার মতো বলে উঠে,"আপনি বড়ো চাচির কথার জন্য পড়াশোনায় মত দিতে পারছেন না তো? " পুষ্প অবাক হয়ে যায়, নিশাত তখন সব শুনে নিয়েছে! এই অসমাপ্ত বাক্য সমাপ্ত করতেই তখন পুষ্পর ঘরে এসেছিলো।


নিশাত আবারও বলে, "শাশুড়ি হলে যে মায়েদের মমতা কোথায় চলে যায়! উনার কথা শোনার দরকার নেই। আপনি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিন। আপনার জীবন আপনার। আপনার জীবনে আসা সুখ-দুঃখ যেহেতু আপনি একা ভোগ করবেন আর করছেন, কেউ সেটার ভাগিদারী হচ্ছে না। সেহেতু আপনার জীবনের ডিসিশনও আপনি নিতে শিখুন। কারো কথার তোয়াক্কা করবেন না। "


পুষ্প কিছু বলতে উদ্যত হবে তখন..... 


চলবে....


  • [message]
    • আপনার মতামত দিনঃ
      • ওরা তিনজন কি পারবে পুষ্পকে রাজি করাতে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

দয়া করে স্পাম করা থেকে বিরত থাকুন।