চন্দ্রাবতী ( পর্ব ১৫ ) |
চন্দ্রাবতী ( পর্ব ১৫ )মিশিতা চৌধুরী
"চন্দ্রা নীল কাল রাতে বাসায় ফেরে নি।তার ফোনটাও বন্ধ।এই মাত্র সাবিনা আন্টি খবর দিলো।"
"কি বলছো ভাইয়া?বাসায় আসে নি মানে?"
চন্দ্রা তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে নদীর পাড়ে গেল।গিয়ে দেখে নীল নেই। চন্দ্রার নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। নিজেকে দোষ দিতে লাগলো।
"এখানে তো কেউ নেই কাকে জিজ্ঞেস করবো আমি।কোথায় তুমি নীল!!!"
ধপ করে নদীর পাড়ে বসে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে লাগলো।এই অবস্থা সে কি করবে বুঝতে পারছে না। কান্না করার সযয় দেখলো একটু দূরে দুইটা ছেলেমেয়ে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া করছিল। কান্না থামিয়ে ওদের কাছে গেল নীলের কথা জিজ্ঞেস করার জন্য।
ফোন থেকে নীলের একটা ছবি বের করে বলল,"আচ্ছা বাবু তোমরা কি এই আঙ্কেল টাকে দেখেছো?"
"না আন্টি দেখি নি।"
তখন চন্দ্রা ওদের একজনের হাতে নীলের ফোনটা দেখতে পেল।
"তোমরা এই ফোনটা কোথায় পেয়েছো?"
একজন বলল,"ঐ ঝোপের মধ্যে"
"দাও দেখি ফোনটা !"
চন্দ্রা হাতে নিয়ে দেখে ফোনটা ভাঙ্গা।"ফোনটার এই অবস্থা হলো কিভাবে?নীল ভেঙ্গে ফেলে নি তো!"
হাজারটা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ছুটলো নীলের বাসায়।বাসায় পৌঁছে ভেতরে ঢুকে দেখে মিসেস সাবিনা কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। নীলাশা বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। চন্দ্রাকে দেখে মিসেস সাবিনা বলল,"চন্দ্রা মা তুই একদম চিন্তা করিস না।পাগলটা হয়তো অভিমান করে কোথাও বসে আছে।আমি পুলিশকে ফোন করেছি।ওরা যতদ্রুত সম্ভব নীলকে খুঁজে বের করবে।"
"আন্টি নীলের কিছু হবে না তো।"
নীলাশা বলল"ভেবো না চন্দ্রা।মম দেখছে ব্যাপারটা।"
"আন্টি আমি নীলের ফোনটা পেয়েছি নদীর পাড়ে। যেখানে নীল গতকাল আমায় নিয়ে গেছিলো।"
"কখন গিয়েছিল তোমরা?"
"বাসায় ফেরার খানিকক্ষণ আগে।"
মিসেস সাবিনা নীলের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলেন ফোনটা ভাঙ্গা।ফোনটা দেখে মিসেস সাবিনার ভয়টা ক্রমশ বাড়তে লাগলো।
"ছেলেটা রাগের মাথায় উল্টা পাল্টা কিছু করে বসে নি তো!"
"নীলু তোর বাবার আসতে কতক্ষন লাগবে?"
"মম বাবা বললো তো দুই ঘণ্টা। রাস্তায় যা জ্যাম মনে হয় এর চেয়ে বেশি সময় লাগবে।"
"নীলু আমি থানায় যাচ্ছি।তুই বাসায় থাক।নীল যদি এর মধ্যে ফিরে আসে তবে আমায় ফোন করবি।"
চন্দ্রা বলে উঠলো,"আন্টি আমিও যাবো তোমার সাথে।"
"ঠিক আছে চলো।"
চন্দ্রা আর মিসেস সাবিনা থানায় গেলেন।
"অফিসার আমার ছেলের কোনো খোঁজ পেয়েছেন?"
"না ম্যাডাম ওনার ফোনের লোকেশন জানার চেষ্টা করছি। তাছাড়া প্রত্যেকটা থানায় ওনার ছবিসহ ডিটেলস পাঠানো হয়েছে
"লোকেশন জেনে লাভ হবে না। ফোনটা আমরা পেয়েছি।"
"কোথায় পেয়েছেন?
চন্দ্রা তখন সবটা বলল।সব শুনে অফিসার বললেন,"ম্যাডাম সারপ্রাইজ দিতে চাইলেন তা ঠিক আছে কিন্তু এভাবে ওনাকে ডিপ্রেসড করা উচিত হয় নি।উনি যদি নিজের কোনো ক্ষতি করেন তখন কি হবে ভেবে দেখা দরকার ছিল। যাই হোক আমাদের দায়িত্ব সব রকম ভাবে চেষ্টা করা। আমরা করবো।"
"অনেক ধন্যবাদ অফিসার।"
"আপনারা এখন বাড়ি যান।কোনো খবর পেলে আমরা জানাবো।"
এভাবে পুরো দিন কেটে গেল।নীলের মা বাবা নীলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। চন্দ্রার অবস্থা আরো খারাপ।সে নিজেকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।পরের দিন সকালে পুলিশ অফিসার বাসায় আসলেন। নীলের বাবা বললেন,কি ব্যাপার অফিসার আমার ছেলের কোনো খোঁজ পেয়েছেন।"
"না স্যার ওনার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।হ্যাঁ তবে আপনারা যে গাড়ির নম্বর দিয়েছেন সে গাড়িটার খোঁজ পাওয়া গেছে। খুব বাজে অবস্থা গাড়িটা। লোকাল অফিসার ইনচার্জ জানিয়েছেন কাল রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু গাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। আশেপাশে খোঁজাখুঁজি চলছে।আমরা ওখানে যাচ্ছি। আপনাদের মধ্যে কেউ যেতে চাইলে আসতে পারেন।"
দুর্ঘটনার কথা শুনে সবাই কান্না করতে লাগলো। মিসেস সাবিনা বলল,"কি গো আমার ছেলেটা কোথায় গেল? তুমি যে করেই হোক আমার আব্বাকে আমার কাছে এনে দাও।আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না।"
নীলের বাবা আকরাম আবরার বলে উঠলো,"আহ সাবু তুমি এতো ভেঙ্গে পড়ো না।কান্না করো না তো। কাঁদলে তোমার শরীর খারাপ করবে। আমাদের নীলের কিছু হবে না।"
"অফিসার চলুন আমি যাবো আপনাদের সাথে।"
দুর্ঘটনার কথা শুনে চন্দ্রা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।গলাটা কেমন ধরে আসছে। অস্ফুট কন্ঠে বলল,"আঙ্কেল আমিও যাবো।"
"না চন্দ্রা মা তুমি তোমার আন্টির কাছে থাকো।দেখছো তো সাবুর কি অবস্থা! তুমি ওকে একটু দেখে রেখো।"
আকরাম সাহেব ফায়াজকে নিয়ে পুলিশের সাথে গেলেন। দুর্ঘটনার জায়গায় পৌঁছে দেখে গাড়িটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আকরাম সাহেবের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। সবাই মিলে আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটা লোক এসে বলল,"আপনারা যাকে খুঁজছেন তাকে বেশকিছুক্ষন আগে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।"
আকরাম সাহেব বললেন,"কখন নিয়ে যাওয়া হয়েছে?"
"প্রায় তিন/চার ঘণ্টা আগে।"
পুলিশ অফিসার এসে লোকটাকে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করলেন। আকরাম সাহেব আর ফায়াজ হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হলো। গাড়িতে উঠে নীলাশাকে জানালো। সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে বললো।সদর হাসপাতালে যেতে তাদের দেড় ঘণ্টা লেগেছে।রিসিপশানে গিয়ে নীলের কথা জিজ্ঞেস করলো।রিসিপশানে বসা মেয়েটা বলল,
"আমার কাছে আসা ইনফরমেশন অনুযায়ী যাকে নিয়ে আসা হয়েছে ওনার নাম পরিচয় জানা যায়নি।তবে অবস্থা খুব খারাপ।ওনাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। আপনারা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।"
আকরাম সাহেব আইসিইউর সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর ডাক্তার বের হলেন। ততক্ষণে নীলাশা মিসেস সাবিনা আর চন্দ্রাকে নিয়ে চলে আসলো।
"ডাক্তার সাহেব আমার ছেলে কোথায় ? কেমন আছে আমার ছেলে?এখন কি অবস্থা?"
"দেখুন ওনার অনেক বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।মাথা আর পায়ে খুব বেশি আঘাত পেয়েছেন। উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ যে উনি এখনও বেঁচে আছেন।তবে ২৪ ঘন্টা না গেলে আমরা কিছুই বলতে পারছি না।"
মিসেস সাবিনা এসে বলল,"আমার আব্বা ঠিক হয়ে যাবে তো?"
"চিন্তা করবেন না। আল্লাহকে ডাকুন।"
চন্দ্রা বলল,"নীলের সাথে একবার দেখা করা যাবে?"
"সরি ম্যাডাম আইসিইউর রোগীর সাথে দেখা করাটা আমরা এল্যাউ করি না।"
চন্দ্রা আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।সবাই নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে নীলের সুস্থতা কামনা করতে লাগলো।দেখতে দেখতে দুইদিন কেটে গেল।এই দুইদিন সবার খাওয়া দাওয়া , ঘুম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দুইদিন পর নীলের জ্ঞান ফিরলো।নার্স এসে বললেন---
"আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। একটু পরে ওনাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হবে। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারেন।"
নীলের জ্ঞান ফেরার কথা শুনে সবার কলিজায় পানি এলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। একটু পরে নীলকে দেখতে কেবিনে দেওয়া হলো। আকরাম আর নীলাশা গিয়ে দেখা করে আসলো। মিসেস সাবিনা চন্দ্রাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।তখন ডাক্তার এসে বলল,"কেমন লাগছে নীল সাহেব?"
নীল ধীর গতিতে বলল,"ভালো আছি।"
"ম্যাডাম অ্যাক্সিডেন্টের কারনে ওনার পায়ে বেশ আঘাত লাগে। যার ফলে ওনার হাঁটতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আপনারা ওনার ভালোভাবে খেয়াল রাখবেন যেন পায়ে আর কোনো প্রকার আঘাত না লাগে।"
"আচ্ছা।"
ডাক্তার চলে গেলেন।মিসেস সাবিনা এসে নীলের মাথার পাশে বসলেন।চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,"আব্বা তুই কেমন আছিস?"
নীল বলল,"ভালো আছি মম।"
মিসেস সাবিনা নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্না করে দিলেন।
"আব্বা তুই আমায় মাফ করে দে। আমার জন্যই আজ তোর এই অবস্থা।"
নীল মিসেস সাবিনার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,"মম তোমার কান্না ভরা মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে না। তুমি সবসময় হাসিখুশি থাকবে।"
"ঠিক আছে আব্বা আমি কখনো কাঁদবো না। কিন্তু তুই ও আমায় কথা দে এমন করে অভিমান করে নিজেকে কষ্ট দিবি না কখনো!"
"আচ্ছা মম !"
"চন্দ্রা মা তুই নীলের কাছে বস আমি ডাক্তারের সাথে ভালোভাবে কথা বলে আসি।"
মিসেস সাবিনা চলে যাওয়ার পর চন্দ্রা নীলের পাশে গিয়ে বসলো। চন্দ্রাকে দেখে নীল.....
***চলবে***