চন্দ্রাবতী ( পর্ব ১৪ ) |
চন্দ্রাবতী ( পর্ব ১৪ )মিশিতা চৌধুরী
অফিসে গিয়ে চন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘন্টাখানেক পরে চন্দ্রা অফিসে ঢুকতেই নীল এসে বলল, তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে এক্ষুনি আমার সাথে এসো।"
"কি কথা স্যার?"
"কোনো প্রশ্ন করবে না।যা বলছি শোনো।"
"নীল স্যারকে এতোটা চিন্তিত লাগছে কেন? চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে গতকাল রাতে ঘুমায় নি।কেমন বিধ্বস্ত লাগছে।"
"মনে মনে কথা বলা হলে আমার সাথে এসো।"
চন্দ্রা কথা না বাড়িয়ে নীলের সাথে যাবে এমন সময় বৃষ্টি এসে বলল,"নীল বিদেশের ক্লায়েন্টরা আজকের মধ্যে প্রজেক্টের ফাইলটা মেইল করতে বলেছেন।"
"ওটা কার দায়িত্বে?"
চন্দ্রা বলল,"আমার।"
"বৃষ্টি আমরা একটু বাইরে যাবো তুমি ওনাদের বলে দাও কাল পাঠানো হবে।"
"নীল আঙ্কেল বারবার ফোন করে বলছেন ওই প্রজেক্ট যেন হাত ছাড়া না হয়।আর এখন যদি দেরি করে পাঠানো হয় ওনারা ডিলটা ক্যান্সেল করে দিতে পারে।"
"আচ্ছা। চন্দ্রা ম্যাডাম আপনার কাজটা করতে কতক্ষন লাগবে?"
"স্যার দুইঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।"
"ঠিক আছে।তারপর আপনার সাথে আমার জরুরি কাজ আছে।"
চন্দ্রা কাজ করতে লাগলো।নীল বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে।সময় যেন কাটছেই না।আড়াই ঘন্টা পর চন্দ্রা এসে বলল,"সরার ফাইলটা রেডি হয়ে গেছে এই নিন।"
চন্দ্রা নীলের হাতে ফাইলটা দিতেই সুমন এসে বলল,"চন্দ্রা একটু এদিকে আয়।তোর সাথে একটা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করার আছে।"
চন্দ্রা সুমনের সাথে চলে গেল।নীল ফাইলটা মেইল করে দিলো।মনে মনে রাগ হচ্ছে।"এই মেয়েটা আমায় এমন ইগনোর করছে কেন।"
নীল সুমনের কেবিনে গিয়ে দেখে চন্দ্রা, অভিরাজ আর সুমন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছে।
"চন্দ্রা ম্যাডাম আপনার সাথে কথা আছে।"
সুমন বলল,"স্যার চন্দ্রাকে এখানে লাগবে।"
"সুমন তুমি আজকের জন্য ম্যানেজ করে নাও।"
চন্দ্রা হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।
"স্যার"
"কোনো কথা না একদম চুপ।"
সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি স্টার্ট দিলো।একটা নদীর পাড়ে গিয়ে গাড়ি থামালো। চন্দ্রাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসলো। চন্দ্রা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
"এদিকে আসো মহারানী।"
চন্দ্রা নীলের ডাক শুনে এসে পাশে বসলো।নীল বলতে লাগলো,"তোমার হাত ধরে এভাবে নিয়ে আসার জন্য দুঃখিত। তুমি আমায় এমন অবহেলা করছো। এড়িয়ে চলছো যা আমায় খুব কষ্ট দিচ্ছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। অফিসে থাকলে তোমার একটার পর একটা কাজ আসতো।তাই এখানে নিয়ে এসছি।এটা আমার খুব প্রিয় জায়গায়।যখন তোমার কথা খুব মনে পড়তো এখানে এসে বসে থাকতাম।কারন এই নদীর পাড়ে তোমায় প্রথম দেখেছিলাম। আমার সবুজ পরীটাকে।
চন্দ্রা আমি আর পারছি না।প্লীজ আমায় এভাবে বিরহের দহনে পুড়তে দিও না।আমি যে শেষ হয়ে যাচ্ছি।মম আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে নিজের পছন্দের মেয়ের সাথে। আগামীকাল পাকা কথা বলতে যাবো।প্লীজ চন্দ্রা তুমি কিছু একটা করো।আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না।"
"নীল স্যার মা বাবারা কখনো সন্তানের জন্য খারাপ চায় না।আন্টি খুব বিচক্ষণ একজন মানুষ।আমি ওনাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করি।আমার মনে হয় উনি কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না। আন্টি যা চাইছে আপনি মেনে নি।"
"প্লীজ চন্দ্রাবতী আমায় ফিরিয়ে দিও না।"
"স্যার আমার জীবনের একটা দুর্বিষহ অতীত আছে।সে কালো অধ্যায় আমার জীবনের অভিশাপ।আমি চাইলেই অন্য একটা মানুষকে আমার জীবনের সাথে জড়াতে পারি না।আমি কোনো ভাবে সেই মানুষটার জীবন নষ্ট করতে চাই না। আমার মনে হয় আপনার মমের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সুখের একটা সংসার গড়া উচিত।জীবনকে উপভোগ করুন।স্যার আমি এখন আসছি।আপনি চাইলে আমি চাকরির রিজাইন দিয়ে দেবো।ভালো থাকবেন।
"চন্দ্রাবতী আমায় ছেড়ে যেও না প্লীজ।"
চন্দ্রা চলে গেল।নীল যেন অতল সাগরে হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। সবকিছু যেন অর্থহীন লাগছে।"তুমিও আমায় একা করে দিলে!আমি কি খুব খারাপ চন্দ্রাবতী! তোমায় এত কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম।"
খানিকবাদে নীলের কল আসলো।নীল চিৎকার করে বলে উঠলো,"তুমি আজ বলো কাল বলো তোমার ইচ্ছে।আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না মম। আমার মহারানীকে চাই।"
কলটা কেটে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। কিছু সময় পর গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছে।
এদিকে মিসেস সাবিনা নীলাশা আর আরশিকে নিয়ে চন্দ্রাদের বাড়ি গিয়ে হাজির। ফায়াজ আর আঁখি এসে ওনাদের ভেতরে নিয়ে গেল। আঁখি বলল, "আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো আন্টি?"
"না মা কোনো সমস্যা হয় নি। শুধু নীলকে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছে।"
নীলাশা বলল,"মম তুমি এতো ভেবো না তো।"
মিসেস সাবিনা বলল,"ফায়াজ বাবা বেয়ানকে দেখতে পাচ্ছি না।বেয়ান কোথায়?"
"এইতো আমি আপা।"
চন্দ্রার মা চন্দ্রাকে নিয়ে এলো।
--বাহ চন্দ্রা তোমায় অপূর্ব লাগছে।
--এই নীলু আমার বৌমাকে একদম নজর দিবি না।
মিসেস সাবিনার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
--আয় তো মা আমার কাছে এসে বস।
চন্দ্রা এসে পাশে বসলো।মিসেস সাবিনা চন্দ্রাকে একজোড়া বালা আর একটা আংটি পরিয়ে দিলেন।বললেন---
--চন্দ্রা মা আমার ছেলেটাকে দেখে রাখিস। ও তোকে বড্ড ভালোবাসে। এতো গুলো বছর তোর জন্য অপেক্ষা করে গেছে।তোর খোঁজ পাওয়ার জন্য ছটপট করেছে।এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেছে। প্রতিটা মূহুর্ত তোকে মিস করে গেছে।
--জি আন্টি।
--আন্টি!!!! এখনও আন্টি ডাকবি?
--সরি মা।
মিসেস সাবিনা চন্দ্রার কপালে চুমু খেয়ে বলল, "আমার লক্ষ্মী মেয়ে।আমার পাগল ছেলেটার যে কি অবস্থা কে জানে।ফোন করছি। বন্ধ বলছে।ও হয়তো ভেবেছে ওকে অন্য কারোর সাথে বিয়ে করতে হবে।শোন চন্দ্রা মা তুই যেমন অভিনয় করে যাচ্ছিলি তেমনি করবি।নীল যেন কোনোভাবেই বুঝতে না পারে।"
--ঠিক আছে মা।
চন্দ্রার মা বলে উঠলো,"আপা আপনারা তো কিছুই খাচ্ছেন না।নীলাশা মা ও খাচ্ছে না।"
"হুম আন্টি খাচ্ছি।আন্টি আপনার হাতের রান্নার কোনো তুলনা হয়না।আমি তো আরো অনেক বার খেয়েছি। আঁখি নিয়ে যেত।এই চন্দ্রা আমি কিন্তু মাঝে মাঝে আন্টির হাতের রান্না খেতে আসবো। তুমি কিন্তু আপত্তি করবে না।"
চন্দ্রা মুচকি হেসে বলল," তাহলে তো ভালই হয় তোমার দৌলতে আমি ও খেতে পারবো।"
"বেয়ান এবার আমাদের যেতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন বিয়ের বাকি বেশিদিন নেই।সব জোগাড় করতে হবে। আপনার বেয়াই মশাই আর আমার জামাই বাবাজি ও আসবে খুব তাড়াতাড়ি। আপনারা কিন্তু আমাদের বাসায় আসবেন।"
"জি আপা যাবো।রাতটা থেকে গেলে খুব ভালো লাগতো।"
"আজ নয় বেয়ান।এখন তো আসা যাওয়া লেগে থাকবে।আগে ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হোক।"
--হুম।
--আসছি আমরা।
--সাবধানে যাবেন।
ফায়াজ ওনাদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। চন্দ্রা তার মাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
--কি হয়েছে চন্দ্রা মা?
--নীলের কথা মনে পড়ছে আম্মু। আজকে আমায় নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়েছিল।জানো আম্মু ওনার চোখ মুখ দেখে আমার ভালো লাগে নি।এ দুদিনে কেমন জানি হয়ে গেছে। খুব বিষন্ন দেখাচ্ছিল।
--ভাবিস না মা।যখন নীল বাবা সবটা জানবে তখন অনেক খুশি হবে।নীলকে কখনো কষ্ট দিস না।
--হুম।
--এবার ছাড় আমায়। ওদিকে কতো কাজ পড়ে আছে। আঁখি একা একা কি করছে কে জানে।
চন্দ্রার আম্মু চলে যেতেই চন্দ্রা নীলকে মিস করতে লাগলো।"নীল আমায় আপনি ভুল বুঝবেন না তো। আপনার মমের কথা রাখতে গিয়ে আমায় এই নাটকটা করতে হচ্ছে।আমি জানি আপনি আমায় অনেক ভালোবাসেন।আর আমিও আপনাকে......।"
"ফুফিমনি রিমা আন্টি এসছে।তোমায় ডাকছে। চন্দ্রা বাইরে যেতেই রিমা এসে চন্দ্রাকে ঝাপটে ধরলো।
--ভাবী আমি অনেক খুশি হয়েছি। তুমি শেষমেশ রাজি হবে ভাবতে পারি নি।
--পাগলি একটা। শোনো আজ কিন্তু তুমি যেতে পারবেনা। রাফাত ভাইকে বলে দাও আজ তুমি এখানেই থাকবে।
--হুম ভাবি আমি তো বলে এসেছি।মা বাবা চলে যাওয়ার পর আর কোথাও যাওয়া হয় না।আন্টি রাফাতকে কল করে বলল বেড়াতে আসার জন্য। কিন্তু রাফাত তো খুব ব্যস্ত।তাই আমি চলে এসেছি।
--খুব ভালো করেছো রিমা। আমার কথা শুনেছো।এতে আমি খুব খুশি হয়েছি।
--তুমি তো আমার মায়ের মতো। তোমার কথা ফেলতে পারি বলো? কয়েকদিন ধরে ভাবীকে দেখার ইচ্ছা করছে। তাই দেরী না করে চলে এলাম।
--চন্দ্রা রিমা মাকে নিয়ে ঘরে যা। একটু বিশ্রাম নিক। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
চন্দ্রা রিমাকে নিয়ে গেল। একটু পরে আঁখি এলো।তিনজন মিলে অনেকক্ষন গল্প করলো।গল্প আড্ডা শেষে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়লো। চন্দ্রা আর রিমা একই রুমে শুয়েছে।
--রিমা তোমায় একটা কথা বলা হয় নি।
--কি কথা ভাবী?
--অভি আর আমি একই অফিসে চাকরি করি।
--কি বলছো কি?
--হুম।দুইদিন আগে তানিয়া আসলো অভির সাথে কথা বলার জন্য।
--তারপর??
চন্দ্রা রিমাকে সেদিনের সব ঘটনা খুলে বলল।রিমা বলল---
--ভাবি তোমার কি মনে হয়?মা বাবা কি এতো সহজে ভাইয়া আর তানিয়াকে মাফ করে দেবে?
--জানি না।ওইজন্য তো তোমায় জিজ্ঞেস করলাম।
--ভাবি ওরা যা যা অন্যায় করেছে তোমার সাথে তাতে মা বাবা ক্ষমা করলেও আমি কখনো ক্ষমা করবো না।
--এভাবে বলো না। ওদের কিবা বয়স!ওদের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
--তার জন্য ওরা নিজেরা দায়ী। তোমার জীবনটা ওরা নষ্ট করে নরক করে তুলেছে আর তুমি ওদের ভালোর কথা ভাবছো!
--ভালোর কথা ভাবছি কিন্তু আমিও ওদের মাফ করি নি। কিন্তু এটাও ঠিক অভি আর তানিয়া যদি আমায় না ঠকাতো তবে নীলের মতো এমন একটা মানুষকে পেতাম না।
--হুম ঠিক বলেছো।নীল ভাইয়া তোমায় অনেক ভালোবাসে।
চন্দ্রা আর রিমা কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ফায়াজের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় চন্দ্রার। তাড়াহুড়ো করে বাইরে গিয়ে বলে,"কি হয়েছে ভাইয়া? তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন?"
"চন্দ্রা নীল.........
***চলবে***